মধুরাপুরে নেই মধুর সম্পর্ক, সংঘাতে প্রাণ গেছে চারজনের

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কালিয়াগোটা হাওরপারের গ্রাম মধুরাপুর। এই গ্রামে জলমহাল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধ চলছে বহুদিন থেকে। এর জেরে প্রায়ই ঘটে ছোট-বড় সংঘর্ষ। আর সংঘর্ষ হলে চলে বাড়িঘরে লুটপাট ও ভাঙচুর। গত ২০ বছরে সংঘর্ষে প্রাণ গেছে চারজনের। দুই পক্ষের মধ্যে এখন হত্যা, লুটপাট, মারামারিসহ নানা ঘটনায় মামলা চলমান আছে ডজনখানেক।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রামের পাশে থাকা ছোট কয়েকটি বিল ও ডোবা নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধের শুরু। এসব বিল ও ডোবা প্রতিবছর ইজারা দিয়ে সেই টাকা ব্যয় হতো গ্রামের মসজিদ ও ঈদগাহের উন্নয়নে। একসময় ইজারার টাকা নিয়ে শুরু হয় বিরোধ। গ্রামের মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এখন এক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন মামুন চৌধুরী, দিলহক তালুকদারসহ অন্যরা; অপর পক্ষে নুর জালাল, শহিদ মিয়া, শিপু মিয়াসহ আরও কয়েকজন।

সর্বশেষ গত ১৩ অক্টোবর দুই পক্ষ ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে মারা যান নূর মোহাম্মদ (৪৫) নামের এক জেলে। আহত হন অর্ধশত লোক। টানা তিন ঘণ্টা সংঘর্ষ চলাকালে এক পক্ষ আরেক পক্ষের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এখনো ভয়ে বাড়িছাড়া এক পক্ষের শতাধিক পরিবার। এ ঘটনায় ৯৯ জনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন নিহত নূর মোহাম্মদের ছেলে হিরণ মিয়া। এই মামলায় জেলে আছেন ৪৪ জন। অন্য পক্ষের আরেক মামলায় আসামি আছেন ৮৮ জন।

মধুরাপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক ঘরে লোকজন নেই। ঘরের বেড়া, দরজা-জানালা, আসবাব ভাঙা। কোনো কোনো ঘরের চালও খুলে নেওয়া হয়েছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পাকা দেয়াল। ঘরের ভেতর ইট-সুরকির স্তূপ। ধানের খালি গোলা। উঠানে থাকা কয়েকটি নলকূপের পাইপের ভেতর বালু-পাথর দিয়ে অকেজো করে রাখা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বেশির ভাগ ঘরই দিলহক পক্ষের লোকজনের।

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, গ্রামে এই বিরোধের জেরে ২০০১ সালে প্রথম নিহত হন লোকমান মিয়া নামের এক জেলে। বছরখানেক পর আরেক সংঘর্ষে তাকমিনা বেগম নামের সাত বছর বসয়ী শিশু নিহত হয়। এই দুজন নুর জালালদের পক্ষের লোক। ২০০৬ সালে আরেক সংঘর্ষের ঘটনায় আকিক মিয়া নামের এক কৃষক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তিনি ছিলেন মামুন চৌধুরীদের পক্ষের। এখন অবশ্য আকিক মিয়ার ছেলেরা নুর জালালদের পক্ষে।

এক পক্ষের নেতা মামুন চৌধুরী জানান, গ্রামে একটি পক্ষ আছে, যারা নানাভাবে সাধারণ মানুষকে অত্যাচার-নির্যাতন করে, তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। ১৩ অক্টোবরের সংঘর্ষের পর তাদের পক্ষের অন্তত ২০০ ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নারী-শিশুরা হামলা থেকে রেহাই পায়নি। এসব পরিবার এখন গ্রামছাড়া। পুলিশের কাছে এ বিষয়ে কোনো আইনি সহযোগিতা পাননি তাঁরা।

নুর জালাল বলেন, গ্রামে দিলহক ও তাঁর একটি বাহিনী আছে। তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই বিপদ। এবারও নূর মোহাম্মদকে ধরে তারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। পরে তাঁর লোকজন এগিয়ে গেলে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের সময়ই কিছু ভাঙচুর হয়েছে। ঘটনার পর পুলিশ মোতায়েন ছিল। তখন কোনো ঘরবাড়িতে হামলা হয়নি।

স্থানীয় ভাটিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহজাহান কাজী বলেন, ‘একাধিকবার দুই পক্ষের এই বিরোধ মীমাংসার উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। মাঝখানে কিছুদিন গ্রাম শান্ত ছিল। এখন আবার শুরু হয়েছে। গ্রামটি দুর্গম হাওর এলাকায় হওয়ায় সমস্যা হচ্ছে বেশি।’

সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, মধুরাপুর গ্রামে দুই পক্ষের বিরোধ দীর্ঘদিনের। দুই পক্ষেরই মামলা-মোকদ্দমা আছে। যাদের নামে মামলা আছে, পুলিশ তাদের ধরবে। কিন্তু যারা মামলার আসামি না, তাদের তো গ্রামে থাকতে বাধা নেই।