সন্ত্রাসীদের ভয়ে ৪৩ পরিবার এলাকাছাড়া

পাঁচটি সন্ত্রাসী বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ কক্সবাজারের মহেশখালীর মানুষ। সন্ত্রাসীদের ভয়ে গত তিন বছরে এলাকাছাড়া হয়েছে ৪৩টি পরিবার। আর গত ১৬ বছরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৬০ জন। আহত হয়েছে অন্তত ৬০০ জন।

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উপজেলার হোয়ানক, কালারমারছড়া, শাপলাপুর ও কুতুবজোম—এই চারটি ইউনিয়নে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেশি। সাগরে মাছ ধরার ট্রলার লুট, মুক্তিপণের জন্য সাগরে জেলেদের অপহরণ, ইয়াবা চোরাচালান, লবণ, চিংড়িঘের লুট, দেশি অস্ত্র (বন্দুক) তৈরি ও কেনাবেচায় এই বাহিনীগুলো জড়িত। পাঁচ বাহিনীর সদস্যসংখ্যা শতাধিক।

২০১২ সালের ১৮ জানুয়ারি হোয়ানক ইউনিয়নের কালাগাজীর পাড়ায় হত্যা মামলার আসামি ধরতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন মহেশখালী থানার এসআই পরেশ কারবারি। একই বছরের ২৯ মার্চ রাতে উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওচমান গণিকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তাঁর ছেলে নোমান শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসীরা এখন তাঁদের পুরো পরিবারকে হত্যা করার হুমকি দিচ্ছে।

মহেশখালী থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, সন্ত্রাসীরা তাঁকেও হত্যার হুমকি দিচ্ছে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তিনি যাতে ব্যবস্থা নিতে না পারেন সে জন্য মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র চলছে।

ওসি বলেন, গত সাত মাসে এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪৪টি এলজি, ৬৫টি বন্দুক, একটি রাইফেলসহ ৩১১টি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে অস্ত্রসহ ১০ জন সন্ত্রাসীকে। মহেশখালীতে একে-৪৭ রাইফেলসহ ৯ হাজার অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্র উদ্ধারের জন্য র‍্যাব, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও পুলিশের বিশেষ যৌথ অভিযান পরিচালনা করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

গত ৬ জুলাই কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন

মহেশখালীর ভুক্তভোগী লোকজন। স্মারকলিপিতে এলাকাছাড়া হওয়া ৪৩ পরিবারের তালিকা দেওয়া হয়। এসব পরিবার কক্সবাজার, চকরিয়া ও চট্টগ্রাম শহরে চলে এসেছেন বলে তাঁরা উল্লেখ করেন। স্মারকলিপিতে সই করেন উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ১৪১ বাসিন্দা।

তবে অতীতের তুলনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো বলে দাবি করেছেন স্থানীয় সাংসদ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আশেক উল্লাহ রফিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এলাকায় এখনো বেশ কয়েকটি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে। তারা সাগরে দস্যুতা করছে। উপকূলে লবণ ও চিংড়িঘের দখল এবং চাঁদাবাজি করছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে র‍্যাব ও পুলিশ।

আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হোয়ানক ও কালারমারছড়া ইউনিয়নে গিয়ে কথা হয় চিংড়িঘেরের মালিক, লবণচাষি, স্থানীয় বাসিন্দাসহ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে। সন্ত্রাসীদের তৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে ভয়ে এ নিয়ে কেউ কথা বলতে আগ্রহ দেখাননি। সন্ত্রাসীদের গুলিতে যেসব পরিবারের সদস্য নিহত হয়েছে, তাঁরাও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দেওয়া স্মারকলিপিতে সই করা ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রথম আলো। তাঁদের একজন পানচাষি মোস্তাক আহমেদ। তাঁর বাড়ি উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের কালাগাজীর পাড়ায়। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে সন্ত্রাসীরা তাঁর ঘরবাড়ি ভেঙে দেয়। পরে পরিবার নিয়ে কক্সবাজারে চলে আসেন। এখন শহরের সমিতির পাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় থাকছেন। তিনি বলেন, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কথা বলায় তিনি রোষানলে পড়েন। তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। তাঁর পুরো পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হামিদ, এনাম, জোনাব, আয়ুব, জালাল—এই পাঁচটি বাহিনী মহেশখালীতে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। এর মধ্যে হামিদ বাহিনীর সদস্যসংখ্যা প্রায় এক শ। এ বাহিনীর প্রধান আকতার হামিদ একসময় জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় হত্যা, ডাকাতি, অস্ত্রসহ ১৭টি মামলা রয়েছে। এনাম বাহিনীর প্রধান এনামুল করিমের বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি, অপহরণ, অস্ত্রসহ ৩৭টি মামলা রয়েছে। অপর দুই বাহিনীর প্রধান জোনাব আলী ও আইয়ুব আলীর বিরুদ্ধে আছে হত্যা, অপহরণ, অস্ত্রসহ ১১টি করে মামলা রয়েছে। বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় বাহিনীর সবাই পলাতক রয়েছেন। জালাল বাহিনীর প্রধান জালাল আহমদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে থানায় নয়টি মামলা রয়েছে। তিনি এখন কারাগারের রয়েছেন। তবে বাহিনীর সদস্যরা সক্রিয়।

পুলিশ জানায়, চিংড়িঘের দখল নিয়ে হোয়ানক ইউনিয়নের হেতালিয়া, উমখালি ও আন্নোয়ার ঘোনা এলাকায় দুটি সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। একপক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন এনামুল করিম চৌধুরী অন্যপক্ষে ফেরদৌস চৌধুরী। শুধু এই দুই বাহিনীর মধ্যেই বন্দুকযুদ্ধে গত ১৬ বছরে ১৩ জন নিহত হন।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে মহেশখালীতে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন তালিকাভুক্ত তিন সন্ত্রাসী।

 কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ কে এম ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনটি সন্ত্রাসী বাহিনীর তিনজন সক্রিয় সদস্য পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর তারা (বাহিনী) ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। মহেশখালীর পাহাড়ে অস্ত্র তৈরির আস্তানা উচ্ছেদ ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছেন তাঁরা।

তবে পুলিশের অভিযানের মুখেও সন্ত্রাসীদের তৎপরতা থেমে নেই বলে জানান উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান শরীফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসীর যোগসাজশে অন্য এলাকার সন্ত্রাসীরা তাঁর ইউনিয়নে চাঁদাবাজি ও অপহরণ করছে। লোকজনকে হত্যার হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করছে। এ নিয়ে মানুষ আতঙ্কিত।

অন্যদিকে হোয়ানক ইউপির চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ছয় থেকে সাতজন সন্ত্রাসীর জন্য তাঁর এলাকার শান্তি নষ্ট হচ্ছে। তিনি সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।