সরকারি ব্যাংকের সাবেক তিন এমডি পলাতক

সরকারি খাতের সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়ূন কবির ও বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামের খোঁজ নেই দীর্ঘদিন। এ তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন অগ্রণী ব্যাংকের সদ্য সাবেক এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদ। এর মধ্যে হুমায়ূন কবির কোনো বাধা ছাড়াই শেষ দিন পর্যন্ত চাকরিতে বহাল ছিলেন। অপর দুজনকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় আসামি হয়ে তাঁরা এখন ফেরারি।
এর বাইরে কারাগারে বন্দী রয়েছেন সরকারি একাধিক ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালকও। ব্যাংকের রক্ষকেরা কেউ পলাতক, কেউ জেলে বন্দী। এই হলো রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলোর চিত্র। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ চিত্রই বলে দিচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ব্যাংক তিনটিকে খারাপ করে রেখে গেছেন। এ জন্য দায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়, কারণ তারাই এসব লোককে খুঁজে বের করে নিয়োগ দিয়েছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় নিজেও কোনো তদারক করে না, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শও শোনে না। ফলে এসব এমডি সুযোগ পেয়ে নিজের মতো ব্যাংক চালিয়েছেন।
ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘তাঁদের খুঁজে বের করা কোনো কঠিন কাজ না। বর্তমান-স্থায়ী ঠিকানা আছে, সম্পদ আছে, কেন তাঁদের খুঁজে পাওয়া যাবে না? এটা পুলিশের স্বেচ্ছাগাফিলতি।’
সোনালী ব্যাংকের হুমায়ূন কবির: জানা যায়, ২০১০ সালের ২০ মে সোনালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে যোগ দেন হুমায়ূন কবির। ২০১২ সালের ১৯ মে তাঁর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এর আগে তিনি ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) এমডি ছিলেন। তাঁর দুই বছরের মেয়াদেই ব্যাংকটির সবচেয়ে বড় হল-মার্ক কেলেঙ্কারি ঘটে। তবে ঘটনা প্রকাশের আগেই অবসরে চলে যান তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে হল-মার্ক জালিয়াতির জন্য তাঁকে প্রধানভাবে দায়ী করা হয়।
হুমায়ূন কবিরকে সর্বশেষ দেখা গেছে ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, দুদকে হাজিরা দেওয়ার সময়। ওই সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমার এক সুতা পরিমাণও দোষ নাই।’ দুদকের মামলায় তাঁকে অন্যতম আসামি করা হয়। এরপর দুদক, সোনালী ব্যাংক—কেউই তাঁর খোঁজ করে পায়নি।
সোনালী ব্যাংক থেকে বিদায় নেওয়ার পর হুমায়ূন কবির প্রস্তাবিত নতুন একটি ব্যাংকের এমডি হিসেবে অনানুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ইঙ্গিত না পাওয়ায় সাবেক এক মন্ত্রীর মালিকানাধীন ব্যাংকটিতে পরে আর তাঁর ঠাঁই হয়নি।
সোনালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, তাঁর দুই মেয়ে দেশের বাইরে ছিলেন, তিনিও হল-মার্ক কেলেঙ্কারির কিছুদিন পরই সপরিবারে সেখানে চলে গেছেন। এরপর আর দেশে ফেরেননি। তিনি কানাডায় আছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
হুমায়ূন কবিরের পর ২০১২ সালের ১৭ জুন ব্যাংকটির এমডি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রদীপ কুমার দত্ত। চার বছর পর গত ১৬ জুন তিনি বিদায় নেন। প্রদীপ কুমার দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল, অনেক সময় পরামর্শও নিয়েছি। কিন্তু আমি যোগদান করার পর একাধিকবার খোঁজ করেও পাইনি। চার বছর এমডি থাকাকালীন এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর সঙ্গে দেখা বা কথা বলার সুযোগ পাইনি। তিনি পুলিশের ভয়ে পলাতক রয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে।’
এদিকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আতিকুর রহমান আটকের পর তিনি মারা যান। পলাতক রয়েছেন আরেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মইনুল হক। দুজনকে এ ঘটনায় বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয়েছিল।
বেসিক ব্যাংকের কাজী ফখরুল ইসলাম: বেসিক ব্যাংকের এমডি হিসেবে তিন বছরের জন্য ২০১১ সালের ৯ মে যোগ দেন কাজী ফখরুল ইসলাম। যোগ দেওয়ার পরই একসময়ের ভালো হিসেবে পরিচিত বেসিক ব্যাংকে বড় ধরনের জালিয়াতি সংঘটিত হয়। এ সময়ে গুলশান, শান্তিনগর ও দিলকুশা শাখায় প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে। খারাপ হয়ে যায় ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা। ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে চুক্তি করেও অনিয়ম বন্ধ করতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন স্বয়ং এমডি। তিনি চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে সব ধরনের অনিয়মেই সহায়তা করেন। পরিস্থিতি খারাপ হলে শুনানি শেষে ২০১৪ সালের ২৫ মে তাঁকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এরপর ২০১৫ সালের এসব অনিয়মের অনুসন্ধান শেষে সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামসহ একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। অপসারণের পর থেকে তাঁকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
বেসিক ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, ফখরুল ইসলাম গ্রেপ্তার এড়াতে দেশের বাইরে চলে গেছেন। পরিস্থিতি অনুকূলে এলে ফিরতে পারেন। তাঁকে মালয়েশিয়ায় দেখা গেছে বলে শোনা গেছে।
এদিকে অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ তিন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুস সোবহান, মো. সেলিম ও রুহুল আলমকে অপসারণ করে। এরপর থেকে জেলে রয়েছেন ফজলুস সোবহান ও মো. সেলিম।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, পরিচালনা পর্ষদ ও এমডির সহায়তা ছাড়া এত বড় ধরনের অনিয়ম সম্ভব নয়। তাঁদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি। তাঁরা আটক না হওয়াটা একধরনের দুর্বলতা। মামলার পর এমডিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় দুর্নীতির সহায়ক পরিবেশ আরও বাড়বে। তাঁরা দেশের বাইরে থাকলে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা নিয়ে দেশে এনে তাঁদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
অগ্রণীর সৈয়দ আবদুল হামিদ: সৈয়দ আবদুল হামিদ ২০১০ সালের অগ্রণী ব্যাংকে এমডি হিসেবে নিয়োগ পান। দফায় দফায় তাঁর মেয়াদ বাড়ানোর পর গত ৯ জুলাই ছিল তাঁর শেষ কার্যদিবস। তবে মেয়াদ শেষের ১০ দিন আগে তাঁকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রায় ছয় বছর মেয়াদে অবৈধ নিয়োগ, পদে পদে আইন লঙ্ঘন, নির্দেশনা অমান্য, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানকে উপেক্ষা—এমন নানা উদাহরণ তৈরি করে গেছেন আবদুল হামিদকে। এমডি হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একদিকে তিনি বিভিন্ন গ্রুপকে অনৈতিক সুবিধা দিয়েছেন, অপরদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন নির্দেশনা উপেক্ষা করেছেন। ফলে ছয় বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ হয়েছে দ্বিগুণ, মুনাফা কমেছে পাঁচ গুণ। সানমুন গ্রুপকে অবৈধ সুবিধা দেওয়া ঘটনায় দুদকের মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে এখন তিনি এখন পলাতক।
অনিয়মের কারণে সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের পর এখন আর্থিক খাতে তিনিই প্রধান আলোচিত এমডি। একই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান খান বৃহস্পতিবার জামিন পেয়েছেন।
অপসারণের পর সৈয়দ আবদুল হামিদের খোঁজ পাননি অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতি গবেষক জায়েদ বখ্তও। তিনি গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, তাঁরাই গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। নিয়ম মেনে দায়িত্ব পালন করলে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না। এটা ব্যাংকার ও ব্যাংক খাত দুটোর জন্যই দুর্ভাগ্যজনক।’
জায়েদ বখত বলেন, ‘এমডিরা বোর্ডের কাছে বিভিন্ন তদবির নিয়ে আসেন, যাঁদের তদবির নিয়ে আসেন তাঁরা এমডিদের মেয়াদ বাড়ানোর আশ্বাস দেন। এটা একটা পদ্ধতিগত সমস্যা। এমডিদের যদি নির্দিষ্ট মেয়াদ দিয়ে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হতো, তাহলে এমনটি হতো না। তারাও মেয়াদ বাড়ানোর জন্য গ্রাহকদের পেছনে ছুটত না।’
পলাতক তিন এমডি বিষয়ে দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, মামলার তদন্তের প্রয়োজনে তদন্ত কর্মকর্তারাই আসামিদের গ্রেপ্তার করেন। এ নিয়ে কমিশন বিশেষ কোনো নির্দেশনা দেয় না। আসামি গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে তাঁদের অপরাধের মাত্রা, পালিয়ে যাওয়া কিংবা মামলাকে প্রভাবিত করার সম্ভাবনাসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তবে অনেক সময় গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেও কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার সম্ভব হয় না। গ্রেপ্তার এড়াতে কেউ পালিয়েও যান অনেক সময়। আবার কেউ কেউ আদালত থেকে জামিন নিয়েও বাইরে থেকে যান।