সাংসদ আসলামের দখলে নদী–জলাশয়ের ৫৪ একর

আসলামুল হক

বুড়িগঙ্গা নদী ও তুরাগ নদের জায়গা দখল করে অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংসদ আসলামুল হক। দখল করা জায়গার মধ্যে জলাশয়ও রয়েছে। সব মিলিয়ে দখলের মোট পরিমাণ ৫৪ একরের বেশি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনেই এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। কমিশন বলছে, এই অবৈধ দখল পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু (বছিলা সেতু নামে পরিচিত) পার হলেই ডান পাশে নদীর তীর ঘেঁষে ঢাকা-১৪ আসনের সাংসদ আসলামুল হকের ‘আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন’ ও ‘মায়িশা গ্রুপের পাওয়ার প্ল্যান্ট’। তুরাগ ও বুড়িগঙ্গার সংযোগস্থলের পাশেই পড়েছে পুরো এলাকা। কেরানীগঞ্জের ওয়াশপুর ও ঘাটারচর মৌজা এবং সাভারের শ্যামলাপুর মৌজার এই স্থাপনাকে অবৈধ চিহ্নিত করে গত মার্চ মাসে বিআইডব্লিউটিএ উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গেলে বাধা দেন সাংসদ আসলাম। পরে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন এবং একই সঙ্গে তাঁর দখলে থাকা জমি বুড়িগঙ্গা বা তুরাগের সীমানার মধ্যে পড়েছে কি না, তা নির্ধারণ করতে যৌথ জরিপ পরিচালনার জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনে আবেদন করেন।

বুড়িগঙ্গা ও তুরাগতীরের জায়গা থেকে সাংসদের মালিকানাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য স্থাপনা সরিয়ে নিতে বলেছে কমিশন।

আদালতের নির্দেশ এবং সাংসদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি, জরিপ ও পরিদর্শন শেষে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নিশ্চিত হয়, ওই সব স্থাপনা অবৈধ। সরকারের আটটি সংস্থার সমন্বয়ে কমিশন জরিপ করে। জরিপে উঠে আসা ফলাফলের ভিত্তিতে ১১ নভেম্বর একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে কমিশন। আর অবৈধ দখল উচ্ছেদে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য গত সোমবার (২৩ নভেম্বর) বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ) চিঠি দিয়েছে কমিশন।

জরিপে যুক্ত ছিল ঢাকা জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো), বিআইডব্লিউটিএ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণে নদী রক্ষা কমিশন।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার গত মঙ্গলবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শুনানি, জরিপ এবং পরিদর্শনে সাংসদ, তাঁর আইনজীবী এবং অন্য প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। প্রতিটি ধাপে প্রতিটি পক্ষের উপস্থিতি নিশ্চিত করে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনের সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাঁরা এখন সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিচ্ছেন।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাংসদ আসলাম আবেদনে দাবি করেছিলেন, তাঁর ওই স্থাপনা ৫১ একরের কিছু বেশি জায়গাজুড়ে রয়েছে। কিন্তু জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, জমির পরিমাণ ৫৪ একরের কিছু বেশি। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগতীর এবং বন্দরের সীমার জমি প্রায় ৮ একর, নদীর জমি প্রায় ১৩ একর। বাকি জমি ড্যাপের আওতাভুক্ত।

বিদ্যুৎকেন্দ্র, কারখানা জেটিসহ অন্যান্য স্থাপনা সরিয়ে জমিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। এ ক্ষেত্রে সাংসদ আসলামুল হক তা সরিয়ে নিতে ব্যর্থ হলে বা অনীহা প্রকাশ করলে জেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করবে এবং এর যাবতীয় ব্যয়ভার সাংসদকে বহন করতে হবে বলে মত দিয়েছে নদী রক্ষা কমিশন। এ ছাড়া দখল করা এই জমি ছাড়াও বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষার স্বার্থে এর উজানে ভরাট করা অবশিষ্ট জমিও অবিলম্বে উদ্ধার করার সুপারিশ করেছে কমিশন।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে বক্তব্য জানতে মঙ্গলবার সাংসদ মো. আসলামুল হকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে প্রথম আলো। প্রশ্ন শুনেই তিনি উচ্চ স্বরে হেসে ওঠেন। এরপর বলেন, ‘তাহলে তো সবকিছু বাতিল করতে হবে। মিউটেশন (নামজারি) বাতিল করতে হবে। সিএস রেকর্ড বাতিল করতে হবে। আমরা তো জায়গাগুলো কিনে নিয়েছি ভাইয়া। এ বিষয়ে আদালতে মামলা চলছে। এটা সাবজুডিশ মেটার। আমার বেশি কথা বলা ঠিক হবে না।’

নদী ও জলাশয় ভরাট করে দখলের প্রসঙ্গে সাংসদ আসলাম বলেন, ‘নদী কমিশনের জরিপ করে প্রতিবেদন দেওয়ার কোনো এখতিয়ারই আইনে নেই। কমিশন শুধু সুপারিশ দিতে পারেন। সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। উনারা কী দিলেন না দিলেন, তাতে কিছু যায় আসে না।’ জরিপের জন্য কমিশনে আপনি নিজেই আবেদন করেছিলেন, এই প্রশ্নে সাংসদ বলেন, শুধু নদী কমিশন নয়, আরও ১৭টি দপ্তরে তিনি আবেদন করেছিলেন। নদী কমিশনের এই জরিপের বিষয়ে প্রয়োজনে তিনি আবারও আদালতে যাবেন।

সাংসদের আবেদন ও শুনানি

চলতি বছরের ১৭ মে সাংসদ আসলামুল হক তাঁর দখলে থাকা জমি চিহ্নিত করা এবং তা নদীর তীর অতিক্রম করে কি না, সেই বিষয়টি নির্ধারণের জন্য নদী কমিশনে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত শুনানির বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে।

১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত শুনানিতে সাংসদ আসলাম নিজে উপস্থিত হয়ে অভিযোগ করেন, তাঁর স্থাপনার জায়গা নদী বা নদীর তীর দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে কি না, তা নির্ধারণে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গত বছরের ৫ মে আট সদস্যের কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি তাঁকে কোনো ধরনের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে এবং তাঁর স্থাপনা নদী দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে বলে মত দেয়। কমিটির এই পর্যবেক্ষণ ভুল এবং দলিলনির্ভর নয় বলে শুনানিতে অভিযোগ করেছিলেন সাংসদ।

ওই শুনানিতে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন বলেন, সাংসদের পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের কারণে বুড়িগঙ্গা নদীর ১৪ কিলোমিটার মরে গেছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হলেও উচ্ছেদ করে নদীর জায়গা দখল করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া সাংসদ খাল, নদী ও নদীর তীর ভরাট করে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করায় নৌযান চলাচল বিঘ্ন হচ্ছে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

রাজউকের সহকারী পরিকল্পনাবিদ নবায়ন খীসা ও প্ল্যানিং সেকশন অফিসার আবুল কালাম শুনানিতে অংশ নেন। তাঁরা বলেন, সাংসদের দখলকৃত প্রায় ৩৪ একর জায়গা ড্যাপে বন্যাপ্রবাহ ও জলাশয় এলাকা হিসেবে চিহ্নিত আছে। সেখানে কোনো ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুযোগ নেই। সাংসদের এসব স্থাপনা নির্মাণে রাজউক কোনো অনুমোদন দেয়নি।

গাফিলতি ছিল জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের

বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানান, হাইকোর্ট এক রায়ে ১৯১২ সালের সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) ম্যাপ অনুযায়ী নদীর জমি উদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছেন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের জরিপ ও শুনানিতে অংশ নিয়ে কেরানীগঞ্জ ও সাভারের সহকারী ভূমি কমিশনার বলেছেন, সাংসদের দখল করা জমি সিএস রেকর্ডে নদীর জমি হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। আরএস (রিভিশনাল সার্ভে) রেকর্ডের সময় তা ব্যক্তিমালিকানায় চলে আসে।

নদী রক্ষা কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এ ব্যাপারে প্রতারণামূলক লিখন গণ্য করে ঢাকা জেলা প্রশাসক ও কালেক্টর তা বাতিল করতে পারতেন। কিন্তু তা না করায় সাংসদ স্থাপনা নির্মাণ করে জমি দখলে রাখার সুযোগ পেয়েছেন। আইন অনুযায়ী নদীর জমির মালিক জনগণ এবং রাষ্ট্র। এই জমি তাই কোনো অবস্থাতেই ব্যক্তিমালিকানায় লিজ, বিক্রি বা অধিগ্রহণ করা যাবে না।

এ বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনটি তাঁরা এখনো হাতে পাননি। পেলে তবেই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থাপনা নির্মাণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে লাল শ্রেণিভুক্ত করে ছাড়পত্র নবায়ন করা হয়েছে। নদীর জমি জেনেও অবস্থানগত, পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ), পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া যুক্তিসংগত হয়নি। বিষয়টি আইনেরও পরিপন্থী। এ ক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও রাজউকের সঙ্গে আলোচনা করে নদী রক্ষা কমিশনের অনুমতি সাপেক্ষে ছাড়পত্র দেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, নদী রক্ষা কমিশনের এই বক্তব্যের সঙ্গে তাঁরা একমত নন। ইতিমধ্যে লিখিত বক্তব্য তাঁরা কমিশনে পাঠিয়েছেন।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদীর প্লাবন ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ প্রাকৃতিক জলাধার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অর্থনৈতিক অঞ্চল পূর্ণাঙ্গভাবে স্থাপিত হলে জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। এমনকি নৌ চলাচলের পথ ও সুযোগ আরও সংকুচিত হবে। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টের রায়ে দেশের সব নদীর ‘কাস্টোডিয়ান’ (আইনগত অভিভাবক) করা হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে। জরিপ চালানোর এখতিয়ারও তাদের রয়েছে। নদী কমিশনের এই এখতিয়ার নেই এমনটা বলার কোনো সুযোগ নেই সাংসদের। বরং একজন আইনপ্রণেতা হিসেবে নিজেকে তাঁর এই অবৈধ স্থাপনাগুলো সরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।