সাদমানকে কে ধরেছিল, মারল কেন?

সাদমান সাকিব রাফি
ছবি: সংগৃহীত

মনোয়ারা হোসেনকে ছেলে সাদমান সাকিফের (রাফি) মৃতদেহের ছবি দেখানো হয়েছিল। সাদমানের হাত দুটো বুকের কাছে। দেখে মনে হয় কোনো আঘাত ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন। কে আঘাত করেছিল? কারাই–বা ডেকে নিয়ে গিয়েছিল সাদমানকে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজছে তাঁর পরিবার।

গত ১৩ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির (এপিইউ) ছাত্র সাদমান সাকিফ ওরফে রাফি (২৩) বসুন্ধরা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। সাদমানের মা ওই ঘটনায় ভাটারা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। প্রায় দেড় মাস পর হাতিরঝিল থানা নিশ্চিত করে সাদমান মারা গেছেন। বেওয়ারিশ হিসেবে জুরাইন কবরস্থানে তাঁর মৃতদেহ দাফন করা হয়েছে।

মনোয়ারা হোসেন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কথা বলছিলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। জুরাইন কবরস্থান থেকে ফিরছিলেন এই মা। কান্নার দমকে আটকে যাচ্ছিল তাঁর কথা। তিনি বলছিলেন, ছেলের মৃতদেহ উত্তরখানে তাঁদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করতে চেয়েছিলেন। গত ১৪ জানুয়ারি এক দিনে জুরাইন কবরস্থানে পাঁচজনের লাশ দাফন করা হয়। কোনটি তাঁর ছেলের কেউ বলতে পারছে না। মনোয়ারা বলছিলেন, ‘আমি এমনই হতভাগ্য মা, নিজের ছেলের কবর কোনটি, তা–ও জানতে পারলাম না! কবরের পাশে দাঁড়িয়ে একটু দোয়াও করতে পারলাম না!’

ছেলের খোঁজে হাতিরঝিলে এলেন কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে মনোয়ারা বলেন, ছেলে নিখোঁজ হওয়ার সময় সঙ্গে ল্যাপটপ ও মুঠোফোন ছিল। নম্বরটা বন্ধ ছিল। প্রতিদিনই তাঁরা ফোন করতেন, কিন্তু ফোন খোলা পাচ্ছিলেন না। গত ২৮ জানুয়ারি একজন নারী ফোন ধরেন। তিনি জানান, রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার সময় সিম কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। এর চেয়ে বেশি কিছু ওই নারী বলতে পারেননি। তখন থেকেই তাঁর মন বলছিল, ছেলে শেষ সময়ে হয়তো হাতিরঝিলে ছিল।

সাদমানের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন ছিল না। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কী কারণে সাদমান মারা গেল, তিনি তা বলতে পারছেন না
মো. শাহজাহান, হাতিরঝিল থানার উপপরিদর্শক

মনোয়ারা বলেন, ‘সাদমান নিখোঁজ হওয়ার পর যখন পরিবার থেকে জানানো হয়, ছেলে মুঠোফোন ও ল্যাপটপ নিয়ে বেরিয়েছে, তখন সবাই বলতে শুরু করে, সাদমান জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেছে। কেউ ছেলেকে খুঁজে বের করতে সেভাবে চেষ্টাও করেনি। তিনি বারবারই বলেছেন, ‘ছেলের জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌদি আরবে। লেখাপড়া করছিল মালয়েশিয়ায়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো ঢাকায় এসেছিল, পরে করোনার কারণে আটকে যায়।’ তার মা আরও বলেন, ‘তাঁর ছেলে ঢাকা শহর চেনে না, তার তেমন বন্ধুবান্ধবও ছিল না। কেউ আমার পরিবারকে বিপদে ফেলতে ছেলেকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করতে পারে। কিন্তু কেউ আমার কথা কানে নেয়নি।’

তিনি কি কাউকে সন্দেহ করছেন—এমন প্রশ্নে মনোয়ারা বলেন, যখনই তিনি বলার চেষ্টা করেছেন ছেলেকে কেউ অপহরণ করতে পারে, তখনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলেছে, তাহলে কেউ মুক্তিপণ দাবি করত। মনোয়ারা নিজেও একজন প্রতারকের খপ্পরে পড়েছিলেন। মনোয়ারা প্রশ্নও রাখেন, ‘এমনও তো হতে পারে যারা বুঝতে পেরেছিল যে আমার ছেলেকে খুন করলেই আমরা শেষ। সেদিকটা কেউ কেন খুঁজে দেখল না?’ তাঁর আশঙ্কা, ছেলে সাঁতার জানত না, এ কথা হত্যাকারীরা জানে। তারা হয়তো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল হাতিরঝিলে।

হাতিরঝিল থানার উপপরিদর্শক মো. শাহজাহান সাদমানের মৃতদেহ নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মর্গে নিয়ে যান ময়নাতদন্তের জন্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাদমানের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন ছিল না। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কী কারণে সাদমান মারা গেল, তিনি তা বলতে পারছেন না।’ সাদমানের মুঠোফোন বা ল্যাপটপ উদ্ধার হয়েছে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, মরদেহের সঙ্গে শুধু একটি হেডফোন পেয়েছেন তাঁরা।

অন্যদিকে ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোক্তারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সাদমান জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ঘর ছেড়েছেন, এ কথা কখনোই পরিবারকে বলা হয়নি। তাঁরা পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে বসুন্ধরা এলাকার সব কটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেছেন। সাদমানকে স্বেচ্ছায় বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেছে। ল্যাপটপ, মুঠোফোন, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ ও একটি বিছানার চাদর নিয়ে বের হন তিনি। তাঁর পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। নবায়ন করতে দিয়েছিলেন। সেই কাগজপত্রও তিনি নেননি।

ওসি বলেন, ‘পরিবারের তরফ থেকে তাঁকে জানানো হয়েছিল যে সাদমান বিষণ্নতায় ভুগছিলেন। তাঁর মুঠোফোনের কললিস্টও দেখা হয়। ফুডপান্ডাসহ কিছু খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথা বলার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পরে তাঁরা বিষয়টি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ও সিরিয়াস ক্রাইম ডিভিশনকে জানান। মৃতদেহ উদ্ধার হওয়ায় তাঁরা তদন্ত শেষ করে দিচ্ছেন না। হাতিরঝিল থানা তদন্ত করবে, তাঁরা সহযোগিতা করবেন।’