সাড়ে তিন কোটি টাকা বদির দুই ভাইয়ের অ্যাকাউন্টে

পাঁচ মাদক কারবারির ব্যাংক হিসাবে প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা লেনদেন। তাঁদের মধ্যে সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির দুই ভাই রয়েছেন।

ফাইল ছবি

দুই বছর আগে মাদকবিরোধী অভিযানের মুখে কক্সবাজারের টেকনাফে আত্মসমর্পণ করেছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শতাধিক মাদক কারবারি। তাঁদের ১৩ জনের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে এনেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডি কর্মকর্তারা বলেছেন, পাঁচজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছেন তাঁরা।

এই পাঁচজনের মধ্যে দুজন টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির আপন ছোট ভাই। তাঁরা হলেন, শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক (৩২) ও ফয়সাল রহমান (৩৫)। অপর তিনজন হলেন স্থানীয় ইউপি সদস্য এনামুল হক ওরফে এনাম, নুরুল হুদা ও মোহাম্মদ একরাম। সিআইডি সূত্র বলছে, এই পাঁচজন ইয়াবার বিক্রির টাকা দিয়ে কেউ দর্শনীয় বাড়ি তৈরি করেছেন, আবার কেউ করেছেন গরু-মুরগির খামার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

ইয়াবা বিক্রির টাকা দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা।
হুমায়ন কবির, বিশেষ পুলিশ সুপার, সিআইডি

আবদুর রহমান বদির ভাই শফিক ও ফয়সাল এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। দুজনেরই উপকূলে লবণ উৎপাদন করে বিক্রি করার ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে। তবে তাঁদের এ ব্যবসা শুধু কাগজে-কলমে বলেই তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, বাস্তবে দুই ভাইয়ের লবণের ব্যবসার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ইয়াবা বিক্রি করেই তাঁরা বিভিন্ন সম্পদ করেছেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ফয়সাল রহমানের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। আর শফিকের একটি অ্যাকাউন্টে ৬৫ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর আগপর্যন্ত এসব লেনদেন করেছেন তাঁরা। শফিক ৭০ লাখ টাকা খরচ করে একটি দোতলা বাড়ি তৈরি করেছেন তিনি। এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র আইনসহ বিভিন্ন অভিযোগে আরও চারটি মামলা রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা (জিরো টলারেন্স) ঘোষণার পর ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে দেশে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু হয়। কয়েক মাসের মধ্যে র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এরই একপর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত টেকনাফের ১২৩ জন চিহ্নিত মাদক কারবারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

মাদকবিরোধী ওই অভিযানের সময়ও আলোচনায় এসেছিলেন সে সময়ের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি। তখন কিছু দিন সৌদি আরবে থেকে এসেছিলেন তিনি। পরে ওই বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে বদির জায়গায় তাঁর স্ত্রী শাহীন আকতার চৌধুরীকে কক্সবাজার-৪ আসনে (টেকনাফ-উখিয়া) মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। এখন শাহীন আকতারই ওই এলাকার সংসদ সদস্য।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ইয়াবা বিক্রির টাকা দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা। পাঁচ মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অর্থপাচার আইনে করা মামলার অনুসন্ধান শেষ হয়েছে। এ মাসের মধ্যেই আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার আমদানি–রপ্তানির ব্যবসা রয়েছে। মিয়ানমার থেকে কাঠ এনে বিক্রি করি। ব্যবসা থেকে উপার্জন করেই আমি একটি বাড়ি বানিয়েছি। আমি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত না। আমার যাবতীয় সম্পদের হিসেব সিআইডিকে দিয়েছি।’ তাহলে আত্মসমর্পণ করেছিলেন কেন–প্রশ্নের জবাবে শফিকুল বলেন, বিভিন্ন মহলের চাপের কারণে তখন আত্মসমর্পণ করেছিলেন। বদির আরেক ভাই ফয়সাল বলেন, ‘জেলে থাকা অবস্থায় আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তাকে সম্পদের হিসেব দিয়েছি। ব্যবসা করে টাকা আয় করেছি। ইয়াবার সঙ্গে আমার সম্পূক্ততা নেই। রাজনৈতিক চাপে আত্মসমর্পণ করেছিলাম।’

এদের বাইরে টেকনাফের নীলা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল হুদার (৩৫) অ্যাকাউন্টে এক কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে বলে তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন। স্থানীয়দের তথ্যমতে, পাঁচ বছর আগেও গাড়িচালক ছিলেন নুরুল হুদা। ইয়াবার কারবার করেই তিনি ওই টাকার মালিক হয়েছেন বলে সিআইডি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন। এই পাঁচ বছরে তিনি ইটভাটা ও হাঁস-মুরগির খামার করেছেন। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে গরু ও কাঠ আনার ব্যবসাও শুরু করছেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ২৪টি মাদকের মামলা রয়েছে।

টেকনাফের বন্দর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের এনামুল হকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২৫ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, এনামুল এই অর্থ ইয়াবা বিক্রি করে পেয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১২টি মাদকের মামলা রয়েছে। তবে তিনিও ইয়াবা কারবারে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। এনামুলের দাবি, স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী ও প্রশাসন যোগসাজশ করে তাঁকে তালিকায় ঢুকিয়েছিল।

সিআইডির তথ্য মতে, মোহাম্মদ একরামের ২ কোটি ৪১ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি এই টাকা দিয়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে জমি কিনেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ১১টি মাদকের মামলা রয়েছে। বক্তব্যের জন্য একরাম ও নুরুল হুদার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাদের মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।

সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিলের পর তাঁদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে আদালতে আবেদন করা হবে।