সিনহাকে গুলির কারণ খুঁজতে ওসি প্রদীপকে নিয়ে ঘটনাস্থল ঘুরে গেল র‌্যাব

প্রদীপ কুমার দাশ
ফাইল ছবি

টেকনাফের শামলাপুর তল্লাশিচৌকি থেকে একটু এগিয়ে পেট্রলপাম্পের সামনে থামল র‍্যাবের গাড়িটি। গাড়ি থেকে হাতকড়া পরা এক ব্যক্তিকে নামাতেই উপস্থিত একজন চিৎকার করে উঠলেন, ‘ওই তো প্রদীপ’। সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষমাণ শত শত মানুষ সমস্বরে হইহই করে উঠলেন। সেই রবে প্রকম্পিত হলো শামলাপুরের ঘটনাস্থল।

গত ৩১ জুলাই মেরিন ড্রাইভের এই শামলাপুরেই গুলিতে নিহত হয়েছিলেন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। র‌্যাব জানিয়েছে, সেদিন রাতে সিনহাকে গাড়িসহ দাঁড় করানোর পর মাত্র দুই মিনিটের মধ্যেই গুলি করা হয়েছিল। তদন্তকারীরা এখনো জানতে পারেননি, তল্লাশিচৌকিতে আসলে কী ঘটেছিল।

আরও পড়ুন

গ্রেপ্তার হওয়া তিন আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত র‍্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে যা বলেছেন, তার সবকিছু মিলিয়ে দেখতে শুক্রবার তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ঘটনাস্থলে। আর সেই দৃশ্য দেখতে শত শত মানুষ ভিড় করেছিলেন সেখানে।

আসামিদের এভাবে ঘটনাস্থলে নেওয়ার ব্যাপারে র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার সাংবাদিকের বলেন, ‘সিনহাকে কেন গুলি করা হলো, তার কারণ জানতে আমরা এসেছি। দুই মিনিটের মধ্যে কী এমন ঘটেছিল, যে কারণে সিনহাকে গুলি করতে হলো। সেই কারণ খুঁজতেই ঘটনাস্থলে আসা।’

প্রদীপসহ তিন আসামিকে শামলাপুরে আনার খবর আগেই রটে যায় এলাকায়। এরপর আশপাশের শত শত মানুষ সেখানে ভিড় করতে শুরু করেন। কেউ মসজিদের ছাদে আবার কেউ রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে পড়েন। বেলা দুইটার দিকে শামলাপুর তল্লাশিচৌকির সামনে প্রথমে আসেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম। কয়েক মিনিট পর গাড়ি থেকে নামানো হয় এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতকে। তাঁর হাতে হাতকড়া। তাঁকে দাঁড় করানো হয় তল্লাশিচৌকির সামনে। ৩১ জুলাই রাতে তল্লাশিচৌকিতে কী হয়েছিল, তা দেখান নন্দদুলাল রক্ষিত। নন্দদুলালের বর্ণনামতো র‍্যাব সদস্যরা সড়কের ওপর সাইনবোর্ড লাগিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে আগের অবস্থা তৈরি করেন।

আরও পড়ুন

এরপর সেই রাতের মতো করে টেকনাফের দিক থেকে তল্লাশিচৌকির সামনে এসে থামে একটি সাদা প্রাইভেট কার। কার থেকে প্রথমে একজন নামেন। তিনি গাড়ির পেছনের দিকে চলে গেলেন। এরপর এক ব্যক্তি গাড়ির সামনে এসে অস্ত্র তাক করে ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। তখন কারের দরজা খুলে আরেক ব্যক্তি (সিনহা সাজিয়ে) হাত উঁচু করে নামেন। এরপর ওই ব্যক্তি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁর শরীরে চারটা গুলি করা হয়। গুলি খেয়ে সিনহা কোন জায়গায় পড়েছিলেন, সেই দৃশ্যও দেখান নন্দদুলাল রক্ষিত। উপস্থিত লোকজন ও গণমাধ্যমকর্মীরা দূর থেকে এসব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন।

নন্দদুলালকে গাড়িতে রেখে আরেকটি গাড়ি থেকে নামানো হয় পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। তিনি সিনহা হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি। র‍্যাবের তদন্তকারীরা লিয়াকতকে তল্লাশিচৌকি থেকে একটু দূরে (দক্ষিণে) সেতুর কাছে নিয়ে যান। হাতকড়া পরা লিয়াকত আলীও নন্দদুলালের মতো করে সেই দিনের ঘটনার বর্ণনা দেন।

সবশেষে আরেকটি গাড়ি থেকে নামানো হয় ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে। তাঁর গাড়িটি ছিল তল্লাশিচৌকি থেকে একটু দূরে (উত্তর দিকে) নির্মাণাধীন পেট্রলপাম্পের কাছে। সেখান থেকে র‍্যাব সদস্যরা যখন ওসি প্রদীপকে নিয়ে তল্লাশিচৌকির দিকে যাচ্ছিলেন, আশপাশে উপস্থিত শত শত লোক তখন হইহই চিৎকার করে ওঠেন। চিৎকার শুনে এদিক-সেদিক তাকালেন তিনি, কিছুই বললেন না। এরপর তল্লাশিচৌকির সামনে দাঁড়িয়ে প্রদীপও সেই রাতের ঘটনার বর্ণনা দিলেন তদন্তকারীকে।

আসামিদের ঘটনাস্থলে নিয়ে আসার ব্যাপারে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার। তিনি বলেন, ‘চেকপোস্টে গুলি করা, গাড়িতে পরিচয় জানতে চাওয়া—প্রত্যেকটা ঘটনার আমরা বিশ্লেষণ করছি। এক–দুই মিনিটের মধ্যে গুলি করার মতো পরিস্থিতি কীভাবে হলো, চেকপোস্টের প্রত্যেকটা পয়েন্ট, ব্যারিকেডের দূরত্ব, প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে দূরত্ব—সবকিছু সরেজমিনে দেখতে এখানে আসা।’

সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘সিনহাকে কেন গুলি করা হলো, তার কারণ জানতেই আমরা এসেছি। সিনহা পিস্তল তাক করেছিলেন কি না, আর সেই–বা (লিয়াকত) কেন ফায়ার করলেন, সে বিষয়ে অনেক তথ্য–উপাত্ত সংগৃহীত হয়েছে। এখন সব মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।’

জব্দ মালামাল হস্তান্তর

নীলিমা রিসোর্ট থেকে সিনহা মো. রাশেদ খানের সহকর্মী শিপ্রা দেবনাথের ল্যাপটপ, ইলেকট্রনিক ডিভাইসসহ জব্দ ২৯ প্রকারের মালামাল তদন্তকারী সংস্থা র‍্যাবের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। আদালতের নির্দেশে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে রামু থানায় জব্দ মালামাল গ্রহণ করেন র‍্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিমান চন্দ্র কর্মকার। এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন রামু থানার ওসি আবুল খায়ের।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিমান চন্দ্র কর্মকার বলেন, ল্যাপটপ, মোবাইল, হার্ডডিস্ক, দুই লাখ টাকাসহ ২৯ প্রকার মালামাল র‍্যাবের কাছে দেওয়া হয়েছে। এসব ডিভাইস ব্যবহৃত হয়েছে কি না, তা পরে তদন্ত সাপেক্ষে জানানো হবে।

শিপ্রার আইনজীবী মাহবুবুল আলম বলেন, শিপ্রাকে আটক করার পর নীলিমা রিসোর্ট থেকে তাঁর কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ডিভাইস (মোবাইল ফোন) ও পেনড্রাইভ নিয়ে গেছে পুলিশ। এগুলো থেকে তাঁর ব্যক্তিগত ছবি আপত্তিকরভাবে সম্পাদনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

আদালত সূত্র জানায়, ১৯ আগস্ট বিকেলে র‍্যাবের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ নীলিমা রিসোর্ট থেকে জব্দ শিপ্রার কম্পিউটার, হার্ডডিস্ক, ল্যাপটপ, ডিভাইসসহ ২৯টি সামগ্রী তদন্ত সংস্থা র‍্যাবের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন পুলিশকে। সিনহা হত্যা মামলায় ১৮ আগস্ট প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী ও নন্দদুলাল রক্ষিতকে রিমান্ডে নেয় র‍্যাব।

৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মারিশবুনিয়া পাহাড়ে ভিডিও চিত্র ধারণ করে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকার নীলিমা রিসোর্টে ফেরার পথে শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা। এ সময় পুলিশ সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে আটক করে। পরে নীলিমা রিসোর্ট থেকে শিপ্রা দেবনাথকে আটক করা হয়। দুজনই এখন জামিনে মুক্ত।

সিনহা হত্যা মামলার অপর ১০ আসামির মধ্যে ৭ জনকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে র‍্যাব। তাঁরা হলেন পুলিশের এসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আবদুল্লাহ আল মামুন এবং পুলিশের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আইয়াস। মামলার অপর তিন আসামি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্য এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ সাত দিনের রিমান্ডে র‍্যাব হেফাজতে রয়েছেন। ঘটনার দিন এই তিন আসামিও তল্লাশিচৌকিতে ছিলেন।