সিনহাতেই শেষ হোক সব বিতর্ক

টেকনাফ মডেল থানার সদর দরজা বন্ধ। পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে থানায় প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। গত মঙ্গলবার দুপুরেছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার সদর মডেল থানায় বন্ধ লোহার ফটকের ছোট ফটকটি (পকেট গেট) পর্যন্ত ভেজানো। সেটি ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই রে রে করে তেড়ে আসেন উর্দিপরা কনস্টেবল। জানতে চান—কী পরিচয়, কার কাছে যাবেন?

দেশের সব থানা সব মানুষের জন্য দিনরাত উন্মুক্ত থাকবে, সেটাই পুলিশ প্রবিধানের (পিআরবি) ভাষ্য। তাহলে সদর থানায় ঢুকতে এত জেরা কেন—প্রশ্ন করতেই নিচু হয়ে আসে কনস্টেবলের কণ্ঠস্বর। নরম গলায় বলেন, ‘বুঝতেই তো পারছেন, কী অবস্থায় আছি।’

সদর থানার এই পুলিশ কনস্টেবল সবকিছু পরিষ্কার না করলেও তাঁর ‘অবস্থা’ শব্দটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর কক্সবাজারের পরিস্থিতি কেমন। পুলিশ কনস্টেবলের সঙ্গে এ কথোপকথন গত মঙ্গলবার সকালের। এত কথার পরও শেষ পর্যন্ত ভেতরে যাওয়ার অনুমতি না পেয়ে থানার ফটক থেকেই আমাদের ফিরে আসতে হয়।

এ তো গেল শহরের কথা। কক্সবাজার শহর থেকে ৯১ কিলোমিটার দূরের টেকনাফ মডেল থানায় আমরা যাই মঙ্গলবার দিনে ও রাতে—দুবার। দুবারই চোখে পড়েছে টেকনাফ থানার সদর দরজা বন্ধ। ফটকে নিরস্ত্র পুলিশের বদলে সশস্ত্র পুলিশের (এপিবিএন) পাহারা, হাতে বন্ধ ফটকের চাবি। শুধু জরুরি কেউ এলে পরিচয় নিশ্চিত হয়ে দরজা খুলে দিচ্ছেন। রাতে কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী থানার সামনে গেলে দ্রুত তালা লাগিয়ে দেন দায়িত্বরত কনস্টবেল। বন্ধ ফটকের পাশের দেয়ালে গ্রেপ্তার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের রংতুলিতে আঁকা বিশাল আকারের ছবি। তার নিচে লেখা, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়ানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ’।

আতঙ্কে পুলিশ, অপরাধ রেকর্ড হচ্ছে কম

থানা–পুলিশের এই হাল নিয়ে কথা হয় জেলা পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, শুধু টেকনাফ আর সদর থানা নয়, পুরো জেলার পুলিশ সদস্যরা ভয়াবহ আতঙ্কে আছেন। থানায় মামলা ও সাধারণ ডায়েরির হার কমে গেছে। জেলা পুলিশের কাছ থেকে তিনটি থানার মামলা ও সাধারণ ডায়েরির হিসাব নিয়ে দেখা গেছে, অভিযোগ দায়েরের হার কোনো থানায় অর্ধেক, আবার কোনো থানায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। শুধু মামলা–জিডির হারই কমেনি, ইয়াবা কারবারেও তার প্রভাব পড়েছে। এখন প্রায়ই লাখ লাখ পরিত্যক্ত ইয়াবা উদ্ধার করছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। যদিও আসামি না ধরে শুধু পরিত্যক্ত ইয়াবা উদ্ধারের এই কর্মকাণ্ডকে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখেন।

পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে আছে টেকনাফ থানার পুলিশ। টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের হাতে যাঁরা ক্রসফায়ার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, এখন সেই পরিবারগুলো মুখ খুলতে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সোচ্চার এসব পরিবারের অনেক সদস্য। পুলিশের আশঙ্কা, ইয়াবা কারবারি ও তাদের লগ্নিকারীরা এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। তারা একজোট হয়ে পুলিশের ওপর হামলাও চালাতে পারে। এই আশঙ্কায় শুধু টেকনাফ নয়, সারা জেলায় পুলিশের টহল কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, সড়ক থেকে তল্লাশিচৌকি তুলে নেওয়া হয়েছে, পায়ে হাঁটা টহলও (ফুট প্যাট্রোল) বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জেলার কোথাও পুলিশ সদস্যদের একা একা ঘুরতে দেখা যাচ্ছে না।

কাল রূদ্ররূপে, আজ অসহায়

কক্সবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন, তা একটি ঘটনা বললেই পরিষ্কার বোঝা যাবে। দুদিন আগে জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা একজন সাংবাদিকের কাছে জানতে চান, তিনি কক্সবাজার থেকে টেকনাফে যেতে চান। এই পথে যাওয়া তাঁর জন্য নিরাপদ হবে কি না। ওই সাংবাদিক এ কথা শুনে অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে থাকেন।

কক্সবাজার পুলিশের এই ‘অসহায়’ চেহারা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল রুদ্ররূপে। টেকনাফের মানুষ সে রূপ দেখেছে। মানুষের মোবাইল ফোনে এখন একটি ভিডিও ভেসে বেড়াচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, লকডাউনের সময় বাজারে জিনিসপত্রের দাম যাতে না বাড়ে, সে ব্যাপারে সতর্ক করছেন তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। ভিডিওতে তিনি বলছেন, ‘কেউ যদি জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়, দরকার হলে তাকে নিয়ে আমি মেরিন ড্রাইভে যাব। সেখানে যা করার তা–ই করব।’ মেরিন ড্রাইভে নিয়ে যাওয়ার অর্থ যে ক্রসফায়ারে প্রাণ হারানো, তা কক্সবাজারের মানুষ হাড়ে হাড়ে বোঝেন। দুই বছরে মেরিন ড্রাইভে শতাধিক মানুষ ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন।

এত দিন টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমার দাশ কথায় কথায় যে মেরিন ড্রাইভ নিয়ে গরম বক্তৃতা করতেন, সাধারণ মানুষকে ভয় দেখাতেন, হুমকি দিতেন; সেই মেরিন ড্রাইভই এখন তাঁর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাঁর একার নয়, গোটা পুলিশ বাহিনীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে মেরিন ড্রাইভের একটিমাত্র হত্যাকাণ্ড। এ নিয়ে দুটি পক্ষের মধ্যে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে যে তিক্ততা শুরু হয়েছে, তা নিয়ে সব মহলেই উদ্বেগ রয়েছে।

গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খান। এই হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ সিনহার তিন সহযোগী শ্রিপ্রা দেবনাথ, সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও তাসকিন রিফাত নূরকে আটক করে। রিফাতকে ছেড়ে দিলেও বাকি দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। শিপ্রার বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা করে রামু থানার পুলিশ। নীলিমা রিসোর্ট থেকে তাঁদের ভিডিও তৈরির যাবতীয় সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।

সিনহা হত্যার ঘটনায় হইচই শুরু হয় অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার পরিচয় প্রকাশিত হওয়ার পর। বিশেষ করে পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চলতে থাকে।

এই দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়

সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভেতরে ছোটখাটো দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। ২০০৪ সালে র‌্যাব গঠনের পর থেকে তা অনেকটা প্রকাশ্যে আসতে থাকে। র‌্যাবে কর্মরত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বাগ্‌বিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনার নজিরও আছে। কয়েক বছর আগে পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরের বিদ্বেষ থামাতে র‌্যাবকে পুলিশের অধীন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনের বিশেষায়িত বা অভিজাত বাহিনী করার সুপারিশ করা হয়েছিল। র‌্যাবে পদায়ন নিয়ে এখনো পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। বিশেষ করে পুলিশ সুপার (এসপি) পদের কর্মকর্তারা অধিনায়কত্ব পান না বলে র‌্যাবে যোগ দিতে চান না।

তবে এত দিন এসব নিয়ে কথা না হলেও পুলিশের গুলিতে সিনহা নিহত হওয়ার পর সেই দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। এক পক্ষ প্রকাশ্যে অভিযোগ করে, সিনহাকে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। আরেক পক্ষ থেকে বলা হয়, এটা ঠান্ডা মাথার খুন নয়, তাৎক্ষণিক ঘটনার ফল। দুই পক্ষের মধ্যে বিতর্কের আলোড়ন এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে ৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ পরিস্থিতি সামাল দিতে কক্সবাজার সফর করেন। সেনাপ্রধান এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক সম্ভবত এই প্রথম যৌথভাবে কোনো সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন। দুই বাহিনীর প্রধান যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এর দায় বাহিনীর ওপর পড়বে না। এতে দুই বাহিনীর সম্পর্কে চিড় ধরবে না। এর এক দিন পর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়, পুলিশ আশ্বস্ত করেছে, এটাই শেষ ঘটনা।

আইএসপিআরের এই বিজ্ঞপ্তি নিয়েও পুলিশের ভেতরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা ওই সময় প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ বাহিনী বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। তাঁদের ভাষ্য হলো, এ ঘটনা যিনি বা যাঁরা ঘটিয়েছেন, সব দায় তাঁর বা তাঁদের। এর সঙ্গে বাহিনীর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সে কারণে ‘এটাই শেষ ঘটনা’ এ রকম নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। তবে দুই প্রধানের এই ঘোষণা থেকে যে বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো, কথিত ক্রসফায়ারের যেসব ভাষ্য পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে সব সময় দেওয়া হয়েছে, তা মোটেই চূড়ান্ত সত্য নয়।

জড়িয়ে পড়েছেন অবসরপ্রাপ্তরা

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহত হওয়ায় সেনাবাহিনীর প্রধান এবং পুলিশ বাহিনীর প্রধান মর্মাহত জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এটাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বললেও তা আর ‘বিচ্ছিন্ন’ থাকেনি। সবকিছুই পাল্টাপাল্টি হয়ে গেছে।

সেনাপ্রধান ও পুলিশ মহাপরিদর্শক যেদিন কক্সবাজারে সংবাদ সম্মেলন করেন, সেদিনই ঢাকার মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন। ৫ আগস্টের সেই সংবাদ সম্মেলনে রাওয়া ক্লাবের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) খন্দকার নুরুল আফসার বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিচারবহির্ভূত ‘ক্রসফায়ারে হত্যা’ বা ‘হারিয়ে যাওয়ার’ মাধ্যমে ব্যক্তিকে গায়েব করে অপরাধ দমনের প্রবণতার নেতিবাচক দিক প্রকাশ পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগতভাবে প্রত্যক্ষ উৎসাহ কিংবা পরোক্ষ প্রশ্রয় না পেলে এ ধরনের অপরাধ কখনোই প্রবণতায় রূপান্তরিত হতে পারে না। এরপর রাওয়া ক্লাবের সেক্রেটারি জেনারেল লে. কর্নেল (অব.) এ এন মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তাঁদের দাবি পূরণ না হলে দরকার পড়লে তাঁরা রাস্তায় নামবেন।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের এই বক্তব্যের পর পুলিশও কথা বলতে শুরু করে। বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন এবং রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও বিবৃতি দেওয়া হয়। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, এ ঘটনায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের মতো দুটি ঐতিহ্যবাহী ও ভ্রাতৃপ্রতিম বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপপ্রয়াস চলছে। একটি পক্ষ অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য ও অনভিপ্রেত মন্তব্য করছে। এই অপপ্রচার চলমান বিচারিক ও প্রশাসনিক অনুসন্ধানপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।

মাঠপর্যায়ে প্রকট রেষারেষি

মামলা ও সরকারের কমিটির তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। তাই এসব কর্মকাণ্ড তদন্ত ও অনুসন্ধানকে প্রভাবিত করছে কি না, তা বলা যাচ্ছে না। তবে এটা ঠিক যে মাঠপর্যায়ের সব কর্মকাণ্ডে তার প্রভাব পড়ছে। বেশ কিছু ঘটনায় তার প্রমাণও পাওয়া গেছে।

সবচেয়ে আলোচিত ঘটনটি ঘটেছে পুলিশের মামলার তিন সাক্ষীকে নিয়ে। সিনহা হত্যার ঘটনায় টেকনাফ থানায় যে দুটি মামলা করেছিল পুলিশ, তার জব্দ তালিকার সাক্ষী ছিলেন নুরুল আমিন, নাজিম উদ্দিন ও মো. আইয়াজ। সিনহা যে পাহাড়ে গিয়েছিলেন, সেই মারিশবুনিয়ায় এঁদের বাড়ি। ১০ আগস্ট বিকেলে সেই গ্রাম থেকে র‌্যাব তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যায়। এঁদের নিয়ে যাওয়ার পর নুরুল আমিনের মা খালেদা বেগম পুলিশের সহায়তায় টেকনাফ মডেল থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে। এই অপহরণ মামলা করার পরপরই র‌্যাব জানায়, অপহরণের অভিযোগ ঠিক নয়, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরদিন আদালতে পাঠিয়ে তাঁদের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এই তিনজনকেই র‌্যাব সিনহা হত্যার আসামি হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কক্সবাজার আদালতের এক আইনজীবী বলেন, র‍্যাব যেদিন এঁদের আদালতে নিয়ে রিমান্ডের আবেদন করেছিল, সেদিন পুলিশ যদি ‘অপহরণের শিকার’ হিসেবে তাঁদের জবানবন্দি রেকর্ড করার দাবি করতেন, তাহলে আদালতকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো।

আবার সিফাত ও শিপ্রাকে নিয়ে ঘটেছে আরেক ঘটনা। পুলিশের মামলায় গ্রেপ্তার করা সিফাত ১০ আগস্ট ও শিপ্রা দেবনাথ ৯ আগস্ট জামিন পান। জামিন পাওয়ার পর নম্বরবিহীন একটি গাড়িতে তাঁদের তুলে নেওয়া হয়। পরে সৈকতের তীরে সেনাবাহিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের বিশ্রামাগার ‘জলতরঙ্গে’ বসে কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা। মূলত তাঁদের যে কোনো অজ্ঞাত স্থানে নেওয়া হয়নি, সেটা বোঝাতে ওই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তাঁরা জলতরঙ্গেই আছেন। সেখানে থেকে প্রথমে নিজের ইউটিউট চ্যানেলের জন্য একটি ভিডিও প্রকাশ করেন শিপ্রা। সেই ভিডিওতে তাঁদের কক্সবাজারে অবস্থান এবং কাজের বিস্তারিত বিবরণ ছিল।

শিপ্রার এই ভিডিও প্রকাশের পর তাঁর ব্যক্তিগত ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। গত রোববার শিপ্রা বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে পাঠানো একটি ভিডিও বার্তায় অভিযোগ করেন, তাঁর ব্যক্তিগত ছবি সম্পাদনা করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে। সিনহা নিহত হওয়ার পর পুলিশ তাঁর কটেজ থেকে যেসব ডিভাইস নিয়ে যায়, সেখান থেকে ছবি চুরি করে তা ফেসবুকে শেয়ার করা হচ্ছে বলেও শিপ্রা অভিযোগ করেন। এমনকি যারা এসব করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।

সেই অভিযোগ নিয়ে মঙ্গলবার রাতে শিপ্রা যান কক্সবাজার সদর থানায়। সেখানে লিখিত অভিযোগে দুজন পুলিশ সুপারসহ দেড় শ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন। অভিযোগেও শিপ্রা সেনাবাহিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠান জলতরঙ্গকে নিজের বর্তমান ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে পুলিশ তাঁর অভিযোগ আমলে না নিয়ে জানিয়ে দেয়, জব্দ করা সব ডিভাইস রামু থানায় আছে, অভিযোগ করতে হলে সেই থানায় করতে হবে। এরপর শিপ্রা ফিরে এলেও গতকাল পর্যন্ত রামু থানায় অভিযোগ দিতে আর যাননি।

রামু থানার ওসি আবুল খায়ের গতকাল সকালে প্রথম আলোকে বলেন, শিপ্রার ব্যক্তিগত ডিভাইসগুলো রামু থানায় আছে। এখান থেকে কেউ কোনো কিছু ছড়ায়নি।

সিনহা হত্যা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি ১৬ আগস্ট টেকনাফের শামলাপুর মেরিন ড্রাইভের পাশে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ে গণশুনানি করেন। সেই শুনানিতে কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়নি। এমনকি পুলিশের কোনো টহলও সেখানে ছিল না।

পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, কমিটির পক্ষ থেকে ‘কার্যার্থে’ টেকনাফ থানাকে চিঠি দেওয়া হলেও পুলিশকে সেখানে থাকতে দেওয়া হয়নি। টহলের জন্য পুলিশের একটি দল আসার পর কমিটির পক্ষ থেকে তাদের চলে যেতে বলা হয়।

গণশুনানির পর তদন্ত কমিটির ব্রিফিংয়ের সময় কমিটির চেয়ারম্যান, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মিজানুর রহমানকে প্রশ্ন করা হয়, এখানে দায়িত্বরত বাহিনীগুলোর ভেতরে সমন্বয়ের কোনো ঘাটতি আছে কি না। জবাবে তিনি বলেন, তিনি সবার সমান সহযোগিতা পাচ্ছেন।

১৭ আগস্ট র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন শামলাপুরের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। সে সময় তাঁর সঙ্গে এপিবিএনের সদস্য ছাড়া জেলা পুলিশের কোনো গাড়ি দেখা যায়নি। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকেরা জানতে চান, বাহিনীগুলোর ভেতরে সমন্বয়হীনতা কেমন। জবাবে তিনি বলেন, কোনো সমন্বয়হীনতা নেই। সবাই কাজ করছে। এ ঘটনায় তিনি নিজেও বিব্রত না হয়ে পেশাদার হিসেবে কাজ করছেন বলে জানান।

মূলে কক্সবাজারের নিয়ন্ত্রণ

কক্সবাজারে বিভিন্ন শ্রেণির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, সিনহা হত্যা নিয়ে বাহিনীগুলোর ভেতরের বিরোধ নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা ভালো চোখে দেখছেন না কেউ। অনেকে বলছেন, কক্সবাজার দেশের এমন একটি এলাকা, যেখানে সবকিছুই আছে। এখানে সাগর, পর্যটন, বন, রোহিঙ্গা, মাছের ঘের, শুঁটকি ব্যবসা, মাদক, মানব পাচার—সবই আছে। বৈধ-অবৈধ পথে আয়ের অবারিত সুযোগ আছে এখানে। সে কারণে কক্সবাজার কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তা নিয়ে যেন লড়াই শুরু হয়েছে। এ লড়াই বন্ধ করার কথা বলছেন সাধারণ মানুষ।

কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারের আকাশে–বাতাসে টাকার ছড়াছড়ি। এই জেলায় মাসে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেই কমপক্ষে দেড় হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। দেশের আর কোনো জেলায় এত বৈধ সম্পদের উৎস নেই।

ব্যবসায়ী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, শুধু বৈধ সম্পদই নয়, এখানে অবৈধ সম্পদেরও ছড়াছড়ি। এই পথ দিয়ে যে ইয়াবার চালান আসে, বছরে তার পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। এরপর আছে রোহিঙ্গা ও মানব পাচারের অর্থ। সব মিলিয়ে এই জেলায় হাজার হাজার কোটি টাকার কারবার চলে।

মানা না–মানা ও আশাবাদ

কক্সবাজারের সাধারণ মানুষ ও রাজনীতিকেরা বিষয়টিকে এভাবে দেখলেও পুলিশ কর্মকর্তারা বিষয়টি এভাবে দেখতে চান না। তাঁরা বলছেন, এসব সাময়িক বিষয়, আলোচনার মাধ্যমেই সঠিক সমাধান হবে।

কক্সবাজারের পরিস্থিতি নিয়ে গত মঙ্গলবার রাওয়া ক্লাবে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এক দল পুলিশ কর্মকর্তা। বৈঠকে ছয় সদস্যের পুলিশ দলের নেতৃত্ব দেন থানা ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা রাওয়া ক্লাবের নেতৃবৃন্দসহ অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসেছিলাম। তাঁদের কিছু প্রশ্ন ছিল, তা পরিষ্কার করা হয়েছে।’ তিনি আশা করছেন, এর মাধ্যমে সব ভুল–বোঝাবুঝির অবসান হবে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, শিপ্রার ভিডিও কোনো হ্যাকার ফাঁস করেছে। তবে কিছু পুলিশ কর্মকর্তা অতি আবেগের বশে সেটা শেয়ার করেন। আর সিনহা ও শিপ্রাকে নিয়ে যারা গুজব ছড়িয়েছে, তারা পুলিশ নয়, তৃতীয় কোনো পক্ষ।

সেনা কর্মকর্তাদের পক্ষে রাওয়া ক্লাবের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) খন্দকার নুরুল আবছার ছাড়াও ১২ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সেই বৈঠকে অংশ নেন। এই দলের সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিনহা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মতো আমরাও বিচলিত। আমরা চাই দ্রুততার সঙ্গে সত্য উদ্‌ঘাটনের ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কিন্তু এ নিয়ে এখন যা হচ্ছে, তা চলতে পারে না। দুই বাহিনীর ভেতরে এমন বিরোধ চলতে থাকলে অন্য কেউ তার সুযোগ নিতে পারে।’

বৈঠক প্রসঙ্গে মইনুল ইসলাম বলেন, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পুলিশকে অনুরোধ করা হয়েছে, বিচারপ্রক্রিয়ায় যেন পুলিশ কোনো বাধা সৃষ্টি না করে। সুষ্ঠু বিচারের জন্য পুলিশের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ক্রসফায়ারের মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি বলেন, আজকের বাস্তবতায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে ক্রসফায়ার দিয়ে কোনো কাজ হবে না। যে লক্ষ্যে এটা শুরু হয়েছে, সেই লক্ষ্য সফল হয়নি। শুধু একটি সন্ত্রাস ঠেকাতে আরেকটা সন্ত্রাসের জন্ম দেওয়া হয়েছে।

সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজীবী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, সিনহার মৃত্যু একসঙ্গে অনেক বিষয় সামনে এনে দিয়েছে। এর মধ্যে আছে বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও কাদা–ছোড়াছুড়ি, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত একান্ত বিষয়কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে দেওয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয়।

এ অবস্থায় সবারই আশা, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এ ধরনের হাজারো বিতর্কিত বিষয়ের অবসান হবে। সিনহা হত্যা ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পাবে। আর কক্সবাজার থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের উদ্যোগ শুরু হবে।