সুকাইজুড়ি খাল দখল করে শখানেক পুকুর!

ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার রাজগাতী ইউনিয়নে সুকাইজুড়ি খাল দখল করে শখানেক পুকুর তৈরি করা হয়েছে। এতে খালটির পানিপ্রবাহে বিঘ্ন ঘটার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য ও বোরো সেচ হুমকির মুখে পড়েছে।
এক বছর ধরে পাইকারগাতী, বিলভাদেরা, দরিল্লা ও পূর্ব দরিল্লা গ্রামের লোকজন খালটির মাঝ বরাবর পাড় বেঁধে এসব পুকুর কাটেন। বর্তমানে খালটির প্রায় ১০০ শতক জায়গা দখল করে আরও এক ব্যক্তি পুকুর কাটছেন।
ময়মনসিংহের পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নের সাধারণ সম্পাদক শিবলী আহমেদ বলেন, ‘নদী বা খালের পানি প্রবাহে বাধা দিয়ে পুকুর তৈরি পরিবেশের জন্য হুমকি। সেখানে ঝাড়ে-বংশে মাছ নিধন করা হলে তা জীববৈচিত্র্য হুমকিতে ফেলবে। তাই দ্রুত সুকাইজুড়ি খালটি দখলমুক্ত করার দাবি করছি।’
গত বুধবার পাইকারগাতী গ্রামের মো. সাহেদ আলী (৯০), বিলভাদেরা গ্রামের আবদুস সাত্তারসহ (৬০) ওই চারটি গ্রামের অন্তত ২৫ জনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, সিএস (ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে) রেকর্ডে সুকাইজুড়িকে নদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এটি নরসুন্দা নদীর শাখা। ছোটবেলায় তাঁরা নদীটি প্রমত্তা দেখেছেন। তখন বড় নৌকা চলাচল করত। নদীর প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অংশ রাজগাতী ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নান্দাইল ও ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার পানি এই নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পাশের কিশোরগঞ্জের হাওরে গিয়ে মেশে। রাজগাতীর পাইকারগাতী, পূর্ব দরিল্লা, পাছ দরিল্লা, হিজলদানী, বিলভাদেরাসহ আরও কয়েকটি গ্রামের মানুষ এই নদীর মাধ্যমে উপকৃত হতো। পরে সেচের জন্য বাঁধ দিয়ে নদীর পানি আটকানো হতো। কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার কোনা ভাওয়াল গ্রামে জলকপাট ও নান্দাইলের উলুহাটি গ্রামে নদীটিতে পাকা বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ফলে ১৫-১৬ বছর ধরে পানির প্রবাহ কমে গিয়ে সুকাইজুড়ি নদীর আকার পরিবর্তন হয়ে যায়। ধীরে ধীরে এটি খালে পরিণত হয়। ১৯৮৪ সালের বাংলাদেশ সার্ভে (বিআরএস) রেকর্ডে সুকাইজুড়িকে খাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই খালের পানি দিয়ে আশপাশের ১০০ একর জমিতে বোরো মৌসুমে সেচ দেওয়া হতো। এখন খালটি দখল করে পুকুর তৈরি করার কারণে বোরো ধানের জমিতে সেচ দেওয়া যায় না।
এলাকার লোকজন বলেন, খালটির পাড়ে যাঁদের বাড়ি, তাঁরা মাছ শিকারের জন্য বাড়ির সীমানা বরাবর খালটিতে ছোট ছোট পুকুর তৈরি করেছেন। খালটির দুই পাশে প্রায় এক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে শতাধিক পুকুর কাটা হয়েছে। শীতকালে পুকুরগুলো সেচে সেগুলোতে আশ্রয় নেওয়া মাছ ধরে ঝাড়ে-বংশে নিধন করা হয়। ফলে জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে। সম্প্রতি দরিল্লা গ্রামের মো. মহিউদ্দিন খালটি দখল করে ১০০ শতক জমিতে পাড় বেঁধে পুকুর নির্মাণ করছেন।
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, পূর্ব দরিল্লা হোসাইনিয়া দাখিল মাদ্রাসার সামনে খালের প্রায় এক কিলোমিটারজুড়ে ছোট ছোট পুকুর তৈরি করা হয়েছে। এদিন দরিল্লা গ্রামের মো. মহিউদ্দিন লোকজন দিয়ে খননযন্ত্র দিয়ে পুকুর কাটার কাজ করেন। প্রায় ১০০ শতক জায়গায় পাড় বাঁধার কাজ শেষ হয়েছে। মুঠোফোনে মো. মহিউদ্দিন বলেন, তিনি ঢাকায় ব্যবসা করেন। বাড়িতে স্বজনদের সাহায্য নিয়ে পুকুর কাটছেন। গ্রামের অন্যরা সুকাইজুড়ি নদী দখল করে পুকুর নির্মাণ করেছেন। নদীটির মধ্যে একমাত্র তাঁরই পূর্বপুরুষের জমি রয়েছে। তিনি সেই জমিতেই পুকুর খনন করেছেন। গত ১৯ জানুয়ারি তিনি ভূমি কার্যালয়ে জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আবেদন করেছেন।
রাজগাতী ইউপির চেয়ারম্যান মো. রোকন উদ্দিন বলেন, বিষয়টি জানার পর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তাকে সরেজমিনে দেখে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন। ওই ইউনিয়নের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. হজরত আলী বলেন, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি গিয়ে পুকুর কাটতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না।
বিলভাদেরা গ্রামের মামুন মিয়া বলেন, তাঁদেরও এ ধরনের একাধিক পুকুর রয়েছে। পলি জমে এসব পুকুর ভরাট হয়ে গেলে শুকনো মৌসুমে খনন করা হয়। তবে এবার একজন খননযন্ত্র দিয়ে পুকুর কাটছেন। এতে বাকিরাও উৎসাহিত হতে পারেন।
বিলভাদেরার আবদুস সাত্তার ও পাইকারগাতী গ্রামের মো. সিরাজ মিয়া বলেন, তাঁরা বাড়ি বরাবর খালটিতে গর্ত করে পাড় বেঁধে মাছ ধরার ফাঁদ (পুকুর) তৈরি করেছেন। শুকনো মৌসুমে গর্তের পানি সেচে আটকে পড়া মাছ শিকার করেন। নদীর দুই পাড়ের শতাধিক পরিবারের এ ধরনের গর্ত রয়েছে।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. তামিম আল ইয়ামীন গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, নদী বা খালের গতিপথ বাধাগ্রস্ত হয়—এমন কোনো কাজ করা বেআইনি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, বিষয়টি তাঁকে কেউ জানাননি। সার্ভেয়ার পাঠিয়ে খোঁজ নেবেন।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবদুল মালেক চৌধুরী বলেন, সুকাইজুড়ি খালের একটি অংশে মাছের অভয়াশ্রম তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে উপজেলা মৎস্য বিভাগ। খালটির কিছু অংশ খনন করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ আট লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। তবে নদীটিতে পুরো খনন করা না হলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কাজ। তিনি এ বিষয়টি জেলা উন্নয়ন ও সমন্বয় কমিটির আগামী সভায় তুলবেন।
পাউবো ময়মনসিংহ কার্যালয়ের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (নান্দাইল উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো. শামসুদ্দোহা বলেন, সুকাইজুড়ি খালে কেউ মাছ চাষ করেন কি না, সেটি জানা নেই। জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে কেউ মাছ করতে পারেন। তবে অনুমতি ছাড়া খালের মাঝখানে পুকুর করে মাছ চাষ করতে পারেন না।