স্ত্রীকে তালাক দিয়ে সন্তানকে কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ

চার দিন পর সন্তান ফিরে পেয়ে শ্বশুরপক্ষের লোকজনের মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করছেন গৃহবধূ। বাহাদুরপুর, নান্দাইল, ময়মনসিংহ, ৩০ নভেম্বর। ছবি: প্রথম আলো
চার দিন পর সন্তান ফিরে পেয়ে শ্বশুরপক্ষের লোকজনের মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করছেন গৃহবধূ। বাহাদুরপুর, নান্দাইল, ময়মনসিংহ, ৩০ নভেম্বর। ছবি: প্রথম আলো

সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রায় আড়াই মাসের মাথায় স্ত্রী রোমানা আক্তারকে ডেকে নিয়ে তালাক দিয়েছেন ফরিদ মিয়া নামের এক ব্যক্তি। শুধু তালাকই নন, সেদিন নবজাতককেও মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি মায়ের।

অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন রোমানা। তাঁর দাবি, অস্ত্রোপচারের খরচ তাঁর বাবার বাড়ির লোকজনের দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাই শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে দিতে হয়। তাঁর গরিব ভাই এই অর্থ ফেরত দিতে না পারায় তাঁকে স্বামী তালাক দিয়েছে এবং বাচ্চাকে কেড়ে নিয়েছে। তবে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের দাবি, এসব মিথ্যা অভিযোগ। রোমানা নিজেই বাচ্চাকে দিয়ে গেছে।

এই ঘটনা ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মোয়াজ্জেমপুর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের। ঘটনা জানার পর পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধার করে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেন।

আজ শনিবার বেলা পৌনে একটার দিকে নান্দাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে গিয়ে রোমানা আহাজারি করছিলেন। বুকের ব্যথার চিকিৎসা করানোর জন্য হাসপাতালের বহির্বিভাগে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তিনি অন্য নারীদের কোলে শিশু দেখতে পেয়ে হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে আহাজারি শুরু করেন।

পরিচয় দিয়ে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই নারী এ প্রতিবেদকের হাত ধরে বলতে থাকেন, ‘আমার সন্তানরে উদ্ধার কইরা দেইন, না অইলে আমি বাঁচতাম না।’ এ কথা বলে তিনি কাঁদতে থাকেন।

সন্তান ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিলে কিছুটা স্বাভাবিক হন তিনি। এরপর তিনি জানান, তাঁর বাবা নেই। মা অপ্রকৃতিস্থ। বড় ভাই কাঠ মিস্ত্রির কাজ করেন। সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন। এ অবস্থায় গত বছর তাঁর বিয়ে হয় পাশের গ্রামের মনির উদ্দিনের ছেলে নলকূপ মিস্ত্রি মো. ফরিদ মিয়ার (৩৫) সঙ্গে। এরপর তিনি অন্তঃসত্ত্বা হলে তাঁর বড়ভাই তাঁকে বাবার বাড়ি নাইওর নিয়ে যান। অভাব অনটন থাকলেও যতটুকু সম্ভব ভাই সেটা করেছে।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের একটি ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মেয়ের জন্ম দেন তিনি। তবে ক্লিনিকের খরচের টাকা শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে দিতে হয়েছে। এই বাড়তি খরচার কারণে তার শ্বশুর তার প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। এক সপ্তাহ পর ক্লিনিক থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি বাবার বাড়িতে ওঠেন। চার দিন আগে স্বামী তাকে কাজী অফিসে নিয়ে একটি খাতায় স্বাক্ষর নেয়। পরে জানতে পারেন স্বামী তাঁকে তালাক দিয়েছে। স্বাক্ষরের পর তাঁর কোল থেকে সন্তানকে জোর করে নিয়ে যায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন। সন্তানকে ফিরে পেতে শ্বশুরবাড়ি প্রায় সবাইকে পা ধরে কাকুতি জানিয়েও কোনো ফল পাননি।

আজ বিকেল চারটার দিকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মেয়াজ্জেমপুর ইউনিয়নের নিকাহ নিবন্ধক (কাজী) মো. আবদুল আজিজ ওই গৃহবধূর তালাক নিবন্ধনের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তবে গৃহবধূর সন্তানের কী হবে সেটা তাঁর জানার বিষয় নয় বলে জানান।

হাসপাতাল থেকে রোমানা থানায় গিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) ঘটনা জানান। তখন ওসি রোমানাকে একজন উপপরিদর্শককে সঙ্গে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি বাহাদুরপুর গ্রামে পাঠান। পরে রোমানার হাতে সন্তানকে ফিরিয়ে দেয় শ্বশুরবাড়ির লোকজন।

রোমানার বড় বোন সুফিয়া খাতুন জানান, মায়ের কাছ থেকে দুধের শিশুকে আলাদা করার ঘটনাটি অমানবিক। তাঁর বোন অস্ত্রোপচারের ধকল এখনো কাটাতে পারেনি। ক্ষতও ভালো করে শুকায়নি। এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে অস্ত্রোপচারের টাকা দিতে না পারায় বোনের স্বামী তাঁর বোনকে তালাক দিয়েছে। কোল থেকে সন্তান কেড়ে নিয়েছে।

বাহাদুরপুর গ্রামে গিয়ে এই প্রতিবেদক রোমানার স্বামী ফরিদ মিয়াকে পাননি। ফরিদের বাবাও বাড়িতে ছিলেন না। তবে ফরিদের মা ও দুই চাচা দাবি করেন, রোমানা নিজেই সন্তানকে এখানে দিয়ে গেছে। চাইলে আমরাই সন্তান দিয়ে আসতাম। থানা-পুলিশ করার দরকার ছিল না। তাহলে গত চার দিন আপনারা ওই নারীকে কোলে সন্তান পৌঁছে দেননি কেন-প্রশ্ন করলে কোনো দেননি তাঁরা।

কেন তালাক হলো এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্যের কারণে হয়েছে। অস্ত্রোপচারের খরচ দিত না পারায় এমনটা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে বলেন, এগুলো মিথ্যা কথা।

ফরিদ মিয়ার বাড়ির প্রতিবেশী কয়েকজনের ভাষ্য, বাচ্চাটিকে জোর করেই নিয়ে আসা হয়েছে। অস্ত্রোপচারের টাকা নিয়ে ক্ষোভ ছিল, তবে এ নিয়ে তালাক হতে পারে, তা তারা কল্পনা করেননি।

নান্দাইল মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনসুর আহমেদ বলেন, এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে সাধারণত আদালতের নির্দেশনার প্রয়োজন হয়। কিন্তু এক মায়ের আহাজারি থামাতে পুলিশ একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে তাঁর সন্তানকে উদ্ধার করে কোলে ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে ওই নারীকে আদালতে গিয়ে সন্তানের নিরাপত্তা চাইতে হবে।