স্বামীকে খুন করার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন স্ত্রী

ছবিটি প্রতীকী
ছবিটি প্রতীকী

পরকীয়া প্রেমিককে সঙ্গে নিয়ে নিজের স্বামীকে খুন করার কথা আদালতের কাছে স্বীকার করেছেন শাহিদা বেগম (৩৫) নামের এক নারী। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত গতকাল সোমবার জবানবন্দি রেকর্ড করার পর ওই নারীকে কারাগারে পাঠিয়েছেন।

গত বুধবার রাতে (২০ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নিজ বাসায় খুন হন ইউনূস ব্যাপারী (৫৪)। এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ভাইপো সুমন ২৩ ফেব্রুয়ারি বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের খুনের আসামি করে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্তে গিয়ে মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ সন্দেহভাজন খুনি হিসেবে ইউনূসের স্ত্রী শাহিদাকে গ্রেপ্তার করে।

নিহত ব্যক্তির ভাইপো এবং পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বুধবার রাত ১১টার দিকে বাসার নিচে ইউনূস অচেতন অবস্থায় পড়েছিলেন। তখন তাঁর স্ত্রী শাহিদা চিৎকার শুরু করেন। শাহিদার চিৎকার শুনে ভাইপো সুমন সেখানে আসেন। তখন সুমন চাচা ইউনূসকে নিয়ে যান বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে করে ইউনূসকে নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। এখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক জানিয়ে দেন, ইউনূস আগেই মারা গেছেন।

মামলার বাদী সুমন প্রথম আলোকে বলেন, হৃদ্‌রোগ হাসপাতালে চিকিৎসক যখন মৃত ঘোষণা করেন তখন তিনি চাচার শরীর উল্টেপাল্টে দেখতে থাকেন। একপর্যায়ে খেয়াল করেন, ইউনূসের গলায় কলো দাগ। মাথার পেছনের অংশে রক্ত। এসব বিষয় তিনি তাঁর চাচি শাহিদাকে জানান। চাচি তখন পরামর্শ দেন, চাচাকে বাসায় নিয়ে যেতে। তাঁর কথামতো ইউনূসকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।

ইউনূসের লাশ মোহাম্মদপুরে বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর সুমনসহ নিহত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন পুলিশকে এ ঘটনা জানাতে চান। তাতেও আপত্তি জানান শাহিদা বেগম।

সুমন বলেন, ‘চাচার গলায় দাগ আবার মাথার পেছন দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আমার কাছে স্বাভাবিক মৃত্যু মনে হচ্ছিল না। অথচ চাচি পুলিশকে জানাতে বারণ করছিলেন। তবে আমরা গভীর রাতে পুলিশকে এ ঘটনা জানাই।’

ইউনূস নিহত হওয়ার খবর পেয়ে নিহত ব্যক্তির বাসায় আসেন মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারুকুল ইসলাম। সবার আগে তিনিও নিহত ব্যক্তির স্ত্রীর কাছে জানতে চান, কীভাবে ইউনূস মারা যান।

ফারুকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিকে শাহিদা সবকিছু অস্বীকার করছিলেন। শাহিদার ভাষ্য ছিল, কেউ না কেউ তাঁর স্বামীকে মেরে বাসার সামনে রেখে গেছেন। কিন্তু বাসার অবস্থান এমন যে বাইরে মেরে কোনো লাশ বাসার সামনে রাখা সম্ভব নয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে নিজের স্বামীকে পরকীয়া প্রেমিকের সহযোগিতা নিয়ে কীভাবে খুন করেছেন, তা স্বীকার করেন শাহিদা বেগম। আদালতেও তিনি খুনের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।

ইউনূস ব্যাপরী পেশায় রিকশা মেরামতকারী। মোহাম্মদপুরে বেড়িবাঁধ বোর্ড ঘাটে তাঁর দোতলা বাড়ি। ইউনূস ও শাহিদা দম্পতির বড় মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। এক ছেলের বয়স ১২ বছর, আরেকজনের ৬।

ইউনূস ব্যাপারী স্ত্রীকে নিয়ে বাসার দোতলায় থাকতেন। বাড়ির ছাদে টিনের দুটি ঘর তুলে তা ভাড়া দেন ইউনূস। সেখানকার একটি ঘরে সিরাজ (৪২) নামের এক ব্যক্তি দুই বছর ধরে সেখানে ভাড়া থাকেন। মোহাম্মদপুর এলাকায় তাঁর মোটরসাইকেল সারানোর দোকান আছে। মুন্সিগঞ্জের সিরাজ বিবাহিত হলেও ইউনূসের বাসায় একাই ভাড়া থাকতেন।

বাদী সুমন প্রথম আলোকে বলেন, বুধবার চাচি তাঁর বাবার বাড়ি শরীয়তপুর থেকে বিকেলে বাসায় ফেরেন। চাচার সঙ্গে দেখা হয় সন্ধ্যার সময়। এরপর কী হয়েছে, তা তিনি জানেন না।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ফারুকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বুধবার পরকীয়া প্রেমিক সিরাজের সঙ্গে শাহিদার দেখা হয় পুরান ঢাকার বাবুবাজার সেতুর ওপর। ওই পথ দিয়ে শরীয়তপুর থেকে তিনি ঢাকায় ফেরেন। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে সিরাজকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় ফেরেন শাহিদা। সন্ধ্যার দিকে ইউনূসের সঙ্গে শাহিদার দেখা হয়। পরে তিনি কাজে চলে যান। রাত ৮টার দিকে বাসায় ফিরে স্ত্রীকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। একপর্যায়ে বাসার ছাদে সিরাজের কক্ষে স্ত্রীকে দেখতে পান আপত্তিকর অবস্থায়। তখন তিনি কক্ষে ঢুকলে শাহিদা আর সিরাজ ধাক্কা দিয়ে তাঁকে খাটের ওপর ফেলে দেন।

পুলিশ কর্মকর্তা ফারুকুল বলেন, ইউনূসকে শ্বাসরোধে হত্যা করার পর লাশ সিরাজের কক্ষে ফেলে রাখা হয়। তখন শাহিদা তাঁর সন্তানদের কৌশলে বাসার বাইরে পাঠিয়ে দেন। সিরাজ এর মধ্যে ইউনূসের লাশ বাসার নিচে রেখে যান। নিহত ব্যক্তির ভাইপো সুমন প্রথম আলোকে বলেন, চাচির চিৎকার শুনে সেখানে আসার পর চাচি তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর চাচা স্ট্রোক করেছেন।

আদালতকে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, আসামি শাহিদা বেগম পলাতক আসামি সিরাজকে সঙ্গে নিয়ে ইউনূসকে হত্যা করেছেন বলে স্বীকার করেছেন।