স্বামী–স্ত্রীর ৬১৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ

পুলিশ সূত্র বলছে, রিমান্ডে কখনো প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছেন, কখনোবা নিজের দায় অন্যের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন মনির।

  • মনিরের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্য দুই সদস্যের কমিটি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

  • পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মনির বলেছেন, প্লট দুর্নীতিতে রাজউকের কর্মকর্তারাও জড়িত।

র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়ার পর মনির হোসেন ওরফে ‘গোল্ডেন মনির’
ফাইল ছবি

র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়ার পর অবশেষে মনির হোসেন ওরফে ‘গোল্ডেন মনির’-এর অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দুদক মনিরের নামে ৬১০ কোটি টাকা এবং তাঁর স্ত্রীর নামে সাড়ে ৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছে।

দুদক সূত্র বলছে, অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে কয়েক বছর ধরেই মনিরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছিল। তবে ২১ নভেম্বর তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর এ বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্য দুই সদস্যের কমিটি করেছে দুদক।

অনুসন্ধান কার্যক্রমের অংশ হিসেবে মনির ও তাঁর স্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ জারির জন্য সুপারিশ করে গতকাল মঙ্গলবার কমিশনে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন দুদকের উপপরিচালক মো. সামছুল আলম।

সরকারি নথি চুরি এবং ভুয়া নথি ও জাল দলিল বানানোর অভিযোগে গত বছরের ১৫ অক্টোবর মতিঝিল থানায় মনিরের বিরুদ্ধে রাজউকের নির্বাহী প্রকৌশলী মামলা করেছিলেন। প্রথমে থানা-পুলিশ এবং পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলাটির তদন্ত করে। সবশেষে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত আগস্ট মাসে সিআইডি থেকে নথি দুদকে পাঠানো হয়। তবে দুদক মনিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। এমনকি ওই মামলায় থানা-পুলিশ বা সিআইডি গত এক বছরেও তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকেনি।

এত অল্প সময়ে বিশাল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কারা সহযোগিতা করেছেন, এই প্রশ্নের জবাবে তাঁর দাম্ভিক উত্তর ছিল—তিনি যে কাজেই হাত দিয়েছেন, সবই সোনা হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে যুক্ত পুলিশের একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে এসব কথা বলেছে।

এদিকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে কোনো প্রশ্নেরই সরাসরি উত্তর দিচ্ছেন না মনির। কখনো প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছেন, কখনোবা নিজের দায় অন্যের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। এত অল্প সময়ে বিশাল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কারা সহযোগিতা করেছেন, এই প্রশ্নের জবাবে তাঁর দাম্ভিক উত্তর ছিল—তিনি যে কাজেই হাত দিয়েছেন, সবই সোনা হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে যুক্ত পুলিশের একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে এসব কথা বলেছে।

অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও বৈদেশিক মুদ্রা রাখার অভিযোগে রাজধানীর বাড্ডা থানায় করা পৃথক তিন মামলায় গোল্ডেন মনিরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। গতকাল ছিল রিমান্ডের তৃতীয় দিন। তিন মামলায় ১৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হলেও দুটি মামলার রিমান্ড একই সঙ্গে কার্যকর হওয়ায় কার্যত তাঁর রিমান্ডের মেয়াদ হবে ১১ দিন।

জিজ্ঞাসাবাদে যুক্ত বাড্ডা থানা-পুলিশের একটি সূত্র বলছে, দেড় যুগ আগে মধ্যপ্রাচ্যসহ কয়েকটি দেশ থেকে মনির সোনা আনতেন। সেই সোনা তিনি অস্ট্রেলিয়ায় পাচার করতেন।

পুলিশ বলছে, গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর ও উত্তরার জমজম টাওয়ারের মালিক শফিকুল ইসলাম ওরফে শফি, সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন, গুলশানের সালেহ আহমেদ ও পল্টনের মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। সোনা চোরাচালানের অভিযোগে রিয়াজ উদ্দিন, সালেহ আহমেদ ও মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে মামলা আছে।

গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে জানতে গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে উত্তরখান থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘তাঁর বিষয়ে আপনারা যা জানেন, আমরাও তাই জানি।’

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিনের সঙ্গে গত রাতে কথা বলার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। কিন্তু তাঁর ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।

মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, গোল্ডেন মনির কর ফাঁকি দিয়েছেন কি না, তা খতিয়ে দেখতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে তাঁর আয়কর ফাইল চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বরাদ্দ দেওয়া প্লট কারও একটির বেশি থাকতে পারবে না। মনির রাজউকের পূর্বাচল, উত্তরা, নিকুঞ্জ, কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল ও বাড্ডার ডিআইটি প্রকল্পে কীভাবে মনির নামে-বেনামে শতাধিক প্লটের মালিক হলেন, তা নিয়ে রিমান্ডে প্রশ্ন করা হয়। মনির বলেছেন, তাঁর আর্থিক সক্ষমতা ছিল বলে তিনি এতগুলো প্লটের মালিক হয়েছেন। আর এসব প্লট পেতে দুর্নীতি হয়ে থাকলে তিনি একা নন, এতে রাজউকের কর্মকর্তারাও জড়িত। আর বাসায় বিদেশি মুদ্রা পাওয়ার বিষয়ে বলেছেন, ব্যবসায়িক কাজে তিনি বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। ফেরার সময় এসব মুদ্রা নিয়ে এসেছিলেন।

বাড্ডা থানা ও ডিবির গুলশান বিভাগ মনিরের বিরুদ্ধে করা তিন মামলা যৌথভাবে তদন্ত করছে। অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও বিদেশি মুদ্রার উৎস জানতে এবং এতগুলো সরকারি প্লট কীভাবে পেয়েছেন, সে বিষয়ে তাঁকে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী, পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার

একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২১ নভেম্বর রাজধানীর মেরুল বাড্ডার ডিআইটি প্রকল্প থেকে মনিরকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁর বাসা থেকে গুলিসহ ১টি বিদেশি পিস্তল, ৪ লিটার বিদেশি মদ, ৩২টি নকল সিল, ৮ লাখ টাকার বেশি মূল্যমানের বিদেশি মুদ্রা, ৬০০ ভরি স্বর্ণালংকার এবং ১ কোটি ৯ লাখ টাকা জব্দ করা হয়।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বাড্ডা থানা ও ডিবির গুলশান বিভাগ মনিরের বিরুদ্ধে করা তিন মামলা যৌথভাবে তদন্ত করছে। অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও বিদেশি মুদ্রার উৎস জানতে এবং এতগুলো সরকারি প্লট কীভাবে পেয়েছেন, সে বিষয়ে তাঁকে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।