হত্যার দুই দিন আগেই গর্ত খুঁড়ে রেখেছিলেন বন্ধুরা

  • সুজনের তিন বন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর তাঁরাই লাশের হদিস দেন।

  • পুলিশ বলছে, সুজনের প্রবাসী বাবার পাঠানো টাকার লোভেই এ হত্যাকাণ্ড।

নিখোঁজের চার দিন পর পাওয়া গেল কলেজছাত্র সুজনের লাশ। নিহত সুজনের মাসহ পরিবারের সদস্যদের আহাজারি। গতকাল ঝিনাইদহের শৈলকুপায়।
ছবি: প্রথম আলো

বয়সে সবাই তরুণ। পাশাপাশি গ্রামেই সবার বাড়ি, একসঙ্গে চলাফেরা, আড্ডা দেওয়া। সেই বন্ধুরাই কিনা বন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করে দুদিন আগেই গর্ত খুঁড়ে রেখেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ধারালো অস্ত্র দিয়ে ঘাড়ে কুপিয়ে হত্যার পর সেই গর্তে নিয়ে দেহটা ফেলে মাটিচাপা দেন। পরিকল্পনা ছিল, বন্ধুকে পুঁতে রাখার স্থানটি ইট-খোয়া দিয়ে পাকা করে ফেলবেন। তার আগেই বৃহস্পতিবার রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার আউশিয়া গ্রামের একটি শ্যালো মেশিনের ঘরে মাটি খুঁড়ে কলেজছাত্র সুজন হোসেনের (২০) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর পুলিশ কর্মকর্তারা প্রাণসংহারি বন্ধুত্বের এমন গল্পটি শোনান।

কলেজছাত্র সুজনকে ২০ সেপ্টেম্বর হত্যা করে দুদিন আগে খোঁড়া গর্তে মাটিচাপা দেন বন্ধুরা। বৃহস্পতিবার লাশ উদ্ধার।

২০ সেপ্টেম্বর থেকে নিখোঁজ ছিলেন সুজন। তিনি ওই গ্রামের মালয়েশিয়াপ্রবাসী জিল্লুর রহমানের একমাত্র ছেলে এবং ঝিনাইদহ সিটি কলেজের শিক্ষার্থী। পুলিশ বলছে, বিদেশ থেকে বাবার পাঠানো টাকার লোভেই সুজনকে হত্যা করেন তাঁর বন্ধুরা।

এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া সাকিব হোসেন, নাজমুল আলম ও হৃদয় নিহত সুজনের বন্ধু। পাশাপাশি গ্রামে আধা কিলোমিটারের মধ্যেই তাঁদের সবার বাড়িও

সুজনের পরিবারের সদস্যরা জানান, ২০ সেপ্টেম্বর বিকেলে বাড়ি থেকে সার কেনার জন্য শৈলকুপা বাজারে যান সুজন হোসেন। এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ ছিলেন। প্রথমে তাঁরা নানা স্থানে খোঁজাখুঁজি করেন। একসময় জানতে পারেন শৈলকুপা শহরের হল মার্কেট এলাকা থেকে এক যুবকের সঙ্গে মোটরসাইকেলে সুজনকে যেতে দেখা গেছে। এ খবর পেয়ে তাঁদের সন্দেহ হয়। সুজনের চাচা রবিউল ইসলাম শৈলকুপা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শৈলকুপা থানার এসআই আমিরুল ইসলাম বলেন, সুজনের পরিবারের পক্ষ থেকে কয়েকজনকে সন্দেহ করা হয়।

এরপর তাঁরা দেখতে পান যাঁদের সন্দেহ করা হচ্ছে, তাঁদের কেউ কেউ লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন। এতে পুলিশের আরও বেশি সন্দেহ হয়। পরে ওই গ্রামের সাকিব হোসেন ও নাজমুল আলম নামের দুজনকে ২৩ সেপ্টেম্বর আটক করা হয়। গত বৃহস্পতিবার আটক করা হয় হৃদয়কে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে সব তথ্য। তাঁদের দেখানো মতেই পুলিশ বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে গিয়ে সাকিবদের শ্যালো মেশিনের ঘর থেকে লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসে।

সুজন হোসেন

পুলিশ জানায়, সুজনের কাছে থাকা টাকার লোভে তাঁরা ছেলেটিকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী ২০ সেপ্টেম্বর রাতে শৈলকুপার হল মার্কেট এলাকা থেকে সুজনকে মোটরসাইকেলে তুলে আউশিয়া গ্রামের একটি মেহগনি বাজারে নিয়ে যান সাকিব। সেখানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ঘাড়ে কোপ দিয়ে সুজনকে হত্যা করা হয়। এরপর হত্যাকাণ্ডস্থল থেকে ৪০০ গজ দূরে সাকিবদের শ্যালো মেশিনের ঘরে দুই দিন আগে খুঁড়ে রাখা গর্তে সুজনের লাশ পুঁতে রাখেন বন্ধুরা। তাঁদের পরিকল্পনা ছিল লাশ পুঁতে রাখার জায়গাটি পাকা করে দেওয়ার।

তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আমিরুল বলেন, নিহত সুজন হোসেনের বাবা জিল্লুর রহমান ১৫ বছর ধরে মালয়েশিয়া থাকেন। তিনি যে টাকা পাঠাতেন, তার সব এই ছেলের কাছেই থাকত। সুজন তা বন্ধুদের মাধ্যমে নানা ব্যবসায় বিনিয়োগ করতেন। এর মধ্যে সাকিবের মাধ্যমে কিছু টাকা সুজন সুদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। সম্প্রতি রেলের চাকরির জন্য সুজন একজনকে দুই লাখ টাকা দিয়েছিলেন। আরও পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। সেই টাকাও সুজন জোগাড় করে রেখেছিলেন বলে সাকিবসহ অন্য বন্ধুরা জানতেন। এই টাকার জন্য বন্ধুরা সুজনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

স্থানীয় লোকজন জানান, সুজন তাঁর মা সেলিনা খাতুনকে নিয়ে গ্রামেই থাকতেন। তাঁর একমাত্র বোন নাসরিনের বিয়ে হয়েছে। সুজনদের বাড়ি আউশিয়া গ্রামে আর গ্রেপ্তার হওয়া সাকিব, নাজমুল ও হৃদয়ের বাড়ি হাজামপাড়ায়। গ্রাম পৃথক হলেও তাঁদের সবার বাড়িগুলো খুব কাছাকাছিই। সাকিব কখনো বিদ্যুতের কাজ করেন, কখনো শ্যালো মেশিনের কাজ করেন। নাজমুলও বহু আগে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে বিভিন্ন ছোটখাটো কাজ করতেন। আর হৃদয় কুষ্টিয়ার একটি কলেজে পড়েন।

সুজনের চাচা শফিকুল ইসলাম বলেন, বছরখানেক হলো সুজনের সঙ্গে এই তিনজনের বন্ধুত্ব হতে দেখছেন তিনি। তিনি শুনেছেন মোবাইল ফোনের সূত্রে তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক হয়। এরপর থেকে তাঁদের প্রায়ই একসঙ্গে চলাফেরা করতে দেখতেন তিনি।

তবে স্থানীয় লোকজন জানান, গ্রামের আর দশটা তরুণ যেভাবে চলাফেরা–বন্ধুত্ব করেন, তাঁরাও তেমনি ছিলেন। বন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনায় এই গ্রামের ছেলেরা দুদিন আগে গর্ত করে রেখেছিলেন, তা ভেবেই এখন গায়ে কাঁটা দেওয়ার জোগাড়।

শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা সবাই কিশোর–তরুণ। টাকার জন্যই তাঁরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে।