হামলায় জড়িত পার্শ্ববর্তী দেশ ও আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা

(২১ আগস্ট, ২০০৮ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন। বানানরীতি ও অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।)

বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন কমিশনের নেতৃত্বে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত কমিশনের কাছে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তত্কালীন মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম ২০০৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তাঁর বক্তব্য দেন। তাঁর শপথপূর্বক ওই বক্তব্যের সারসংক্ষেপ তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা হয়েছে। তা নিচে হুবহু দেওয়া হলো-


ঘটনার সময় তিনি (এনএসআই মহাপরিচালক) দেশে ছিলেন না। অসুস্থ হয়ে চিকিত্সার্থে তিনি ব্যাংকক থেকে সিঙ্গাপুরগামী এয়ারবাসে থাকা অবস্থায় ২১ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারেন। সিঙ্গাপুরে সংক্ষিপ্ত চিকিত্সার পরে তিনি দেশে ফেরার পথে যখন প্লেনে ছিলেন, তখন শরীরে একটি এবসেস ব্লাস্ট করে এবং তা থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। 

ফলে দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবার হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতাল বেড থেকে তিনি ঘটনার ওপর নজর রাখেন। এবং এ সমস্ত রহস্য উদঘাটনের জন্য যথাসম্ভব সবাইকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করেন; যদিও বিদেশ যাওয়ার সময় তাঁর সেকেন্ড-ইন-কমান্ডসহ তাঁর অফিসারদের তিনি বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন এবং তত্পর থাকার পরামর্শ দিয়ে যান। হয়তোবা ঢাকায় কিছু ঘটতে পারে, তাঁরা (অফিসাররা) যেন চোখ-কান খোলা রাখেন সে মর্মে নির্দেশ দিয়ে যান। কিছুদিন আগে সিলেটেও বোমা ও গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছে। যাহোক, দেশে ফেরার পরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ঘটনা সম্পর্কে কথা বলেন। ঘটনার সময় তাঁর দেশে না থাকা বা বিশেষ কোনো তত্পরতার অভাব থাকার কারণেও ঘটনাপূর্ব কোনো আগাম তথ্য তাঁর এনএসআই রাখতে পারেনি।

অবিস্ফোরিত গ্রেনেড। ছবি:জিয়া ইসলাম
অবিস্ফোরিত গ্রেনেড। ছবি:জিয়া ইসলাম

দেশে ফেরার পরে এবং অদ্যকার সাক্ষাত্কারের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি ঘটনার কারণ উদ্ভাবনের জন্য সম্ভাব্য জোর তত্পরতা চালানোর পর তিনি ঘটনা সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানতে পেরেছেন। বিশেষ করে তাদের (এনএসআইয়ের) কিছু লোক পার্শ্ববর্তী দেশেও যথেষ্ট তত্পর আছেন এবং কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জানতে পেরেছেন যে নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান কানাডা থেকে ঘটনার বেশ কিছু পূর্বে পার্শ্ববর্তী একটি দেশের বিশেষ একজন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর স্বগ্রামে অবস্থান করে ওই দেশের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশে একটি দুর্ঘটনা ঘটানোর জন্য বিশেষ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এর সঙ্গে তাঁর মতো আরও দু-একজন স্বেচ্ছানির্বাসিত বাংলাদেশের একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন। তারই ফলশ্রুতিতে হঠাত্ করে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২১ আগস্টের ঘটনাটি ঘটে গেছে। এ ঘটনা ঘটানোর পূর্বে আন্দাজ করা গেছে যে বাংলাদেশের একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ড্রাইহার্ড ক্রিমিনালস, তাদেরই পরিচিত কিছু অস্ত্র চোরাচালানি সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত কিছু টেররিস্টকে রিক্রুটকরত পার্শ্ববর্তী একটি দেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি আয়রন বডি ট্রাকের (ট্রাকের ডামি) চারপাশে গ্রেনেড থ্রোয়িংয়ের মহড়া সম্পন্ন করে। এই রিক্রুট লোকজনের বিশেষ ট্রেনিং সমাপনের পরে তাদেরকে বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমে পাঠানো হয় এবং এখানে ঘটনা ঘটানোর জন্য ঘটনাস্থলে পর্যায়ক্রমে একাধিকবার ‘রেকি’ সম্পন্ন করে। যেহেতু এদের অধিকাংশই ওই দিনের ঘটনায় সভাস্থলের নেতা-কর্মীদের চেনে এবং অনেকেই এদের কাছে চেনামুখ, সে জন্য ওই দিন অপারেশন চালাতে তারা বেশ সুবিধা লাভ করে। ঘটনার দিন হামলাকারীরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে অপারেশন চালায়। এখানে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, যদিও ওই দিন সভাস্থলে সাত-আটটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হওয়ার ঘটনা ঘটে বলে মনে করা হচ্ছে, তথাপিও প্রথম বিস্ফোরণটি গ্রেনেড না হয়ে স্প্লিন্টারবিহীন একটি বোমা বিস্ফোরণ বলে মনে হয়। এর দুটি কারণ ছিল, প্রথমটি হলো বিকট শব্দে শৃঙ্খল জনতা বিশৃঙ্খল হয়ে নানান দিকে ছোটাছুটি করবে; অপরটি হলো বোমা থেকে উদিগরীত ধোঁয়া সভাস্থলটিকে আচ্ছাদিত করবে। ফলে এরূপ একটি পরিবেশে আসল গ্রেনেড হামলার সুবিধা হবে। উদীচী থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো নাশকতামূলক ঘটনা বাংলাদেশের মধ্যে ঘটেছে, তার প্রায় সব কটিই ওই বিশেষ দেশের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক ঘটানো হয়েছে। এ সংস্থাটি সব সময় অনেক দূর ও নেপথ্যে থেকে এ দেশেরই কিছু বিপথগামী লোক দ্বারা ঘটনা ঘটিয়েছে। যারা সক্রিয়ভাবে এ ধরনের অপারেশন করে, তাদেরকে কখনোই বুঝতে দেওয়া হয় না যে এর পেছনে একটি দেশের গুপ্তচর গোষ্ঠীর হয়ে তারা এ নাশকতামূলক কাজটি করছে। এরা সব সময় তাত্ক্ষণিক এবং বিশেষ অর্থসহ অন্যান্য সুবিধার মোহে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান ঘটনায় কারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে তা বের করা সময়ের ব্যাপার। তবে ইতিমধ্যে যে কয়জনকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে শৈবাল সাহা ওরফে পার্থ সাহা ও আ. রহমান উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে পার্থকে রিমান্ডে নেওয়ার বিরুদ্ধে হাইকোর্টের আদেশ প্রদানের ফলে তদন্তকাজ অনেকটা ব্যাহত হয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তিনি আরও জানান, দেশের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে তাঁর সংস্থাটিও ঘটনার রহস্য উন্মোচনে তত্পর রয়েছে।