হুজি বিলুপ্তপ্রায়, জঙ্গিদের লক্ষ্য পুলিশ

প্রতীকী ছবি

আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ১৬ বছর আগে দলীয় সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল দুর্ধর্ষ জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদ (হুজি–বি)। বারবার আওয়ামী লীগ ও অসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ওপর হামলাকারী এই জঙ্গিগোষ্ঠী এখন বিলুপ্তপ্রায়। তবে নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এখনো হুমকি হয়ে আছে। তাদের এখনকার লক্ষ্য পুলিশ। এর মধ্যে গত এক বছরে নব্য জেএমবি দেশে ছোট ছোট ১০টি বোমা হামলা চালিয়েছে, এর মধ্যে আটটিই ছিল পুলিশের ওপর। এই জঙ্গিরা ছোট ছোট গ্রুপে সংগঠিত হয়ে নতুন করে নাশকতার চেষ্টায় আছে।

দেশে এ পর্যন্ত যতগুলো জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা দেখা গেছে, এর বেশির ভাগই কোনো না কোনো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর মতাদর্শ নিয়ে কিংবা যোগাযোগের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। তবে হুজি–বির মতো ভারী অস্ত্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সম্মুখযুদ্ধের অভিজ্ঞতা অন্য জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যদের নেই। নব্য জেএমবির হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা বাদ দিলে দেশে সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর হামলা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটিয়েছে হুজি–বি। তাঁরা অন্তত চার দফা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ও সবচেয়ে ভয়ংকর হামলা ছিল ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা।

আগামীকাল সেই ২১ আগস্ট। সেদিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে ২৪ জন নিহত হন। আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ কয়েক শ নেতা-কর্মী।

আফগানফেরত মুজাহিদদের গড়া সংগঠন হুজি-বি গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এ দেশে জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন করেছিল। এরপর ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে এই জঙ্গিগোষ্ঠী দেশে ১৩টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে ১০৬ জন নিহত হন। আহত হন ৭০০–এর বেশি মানুষ।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর এক বছরের মধ্যে হুজি–বির প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এরই মধ্যে হুজির অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। দীর্ঘদিন এই জঙ্গিগোষ্ঠীর কোনো তৎপরতা নেই।

কাল ২১ আগস্ট। ১৬ বছর আগে এই দিনে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল হুজির জঙ্গিরা।

হুজির পর্ব শেষ হয়ে গেলেও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এখন দুটি গোষ্ঠী হুমকি হয়ে আছে, তারা হলো আইএস ও আল–কায়েদা। এ দেশে তৎ​পর আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ নিজেদের আল–কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখা দাবি করে। আর নব্য জেএমবি আইএসের (ইসলামিক স্টেট) মতাদর্শ অনুসরণ করে। এর মধ্যে নব্য জেএমবি দেশে নতুন মাত্রার ঝুঁকি তৈরি করে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে সেটার ভয়ংকর রূপ দেখা গেছে।

এ ছাড়া ২০০৫ সালে একযোগে দেশের ৬৩ জেলায় ৫০০ বোমা ফাটিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসা জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) সাংগঠনিকভাবে অনেক দুর্বল অবস্থায় থাকলেও পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টায় রয়েছে। সংগঠনটি তাদের মতাদর্শ ও সাংগঠনিক তৎপরতা প্রতিবেশী দেশ ভারতেও বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। গত কয়েক বছরে ভারতে বেশ কজন জেএমবির নেতা বা সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে। জেএমবির বর্তমান আমির সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীনও ভারতে অবস্থান করছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে।

জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে নজরদারিতে যুক্ত ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার মতে, আফগানিস্তানের সরকারের সঙ্গে তালেবানদের আলোচনা, সম্প্রতি ৪০০ তালেবান বন্দীকে মুক্তি দেওয়া, তার আগে যুক্তরাষ্ট্রও তালেবানদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করা—এসবকে তালেবানদের বিজয় হিসেবে দেখছে এই উপমহাদেশের জঙ্গিরা। এতে এ দেশের জঙ্গিরাও, বিশেষ করে আল–কায়েদা মতাদর্শী জঙ্গিগোষ্ঠীও বেশ উৎসাহিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের কারাগার থেকে লস্কর–ই–তাইয়েবার প্রধান হাফিজ সাঈদের মতো জঙ্গিনেতাকে মুক্ত দেওয়ার ঘটনাও। এ ছাড়া সিরিয়ায় আইএসের পতনের পর বাংলাদেশের জঙ্গিরা পাকিস্তানকে এখনো নিরাপদ অঞ্চল ভাবছে। উপমহাদেশে ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ হবে, বা খিলাফত প্রতিষ্ঠা হবে; এই লক্ষ্য সামনে রেখে তৎপর জঙ্গিরা।

পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) গত এক মাসে বিভিন্ন এলাকা থেকে আল–কায়েদাপন্থী সংগঠন আনসারুল্লাহ বা আনসার আল ইসলামের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এটিইউর এ–সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই জঙ্গিরা ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে প্রচারণাসহ রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।

 এক বছরে ছোট ছোট ১০টি বোমা হামলা, ৮টির লক্ষ্য পুলিশ।  ‘কথিত আইএসের’ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় নব্য জেএমবি।  ‘গজওয়াতুল হিন্দ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রচারণায় আনসারুল্লাহ।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, আনসার আল ইসলাম শুরু থেকেই আল-কায়েদার কৌশল অনুসরণ করে থাকে। গত কয়েক বছর কোনো ঘটনা না ঘটালেও এই ​গোষ্ঠীর সাংগঠনিক কাঠামো সেভাবে দুর্বল হয়নি। তাদের অনেকে এখনো ধরা পড়েনি।

অন্যদিকে হোলি আর্টিজানে হামলার পর পুলিশ ও র‍্যাবের ব্যাপক অভিযানে নব্য জেএমবির বেশির ভাগ নেতা বা সদস্য নিহত হয়েছে কিংবা গ্রেপ্তার হয়েছে। জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত র‍্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই জঙ্গিগোষ্ঠীর সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে দিয়েছে। বড় কোনো হামলা করার সক্ষমতা তাদের নেই। তবে ‘লোন উলফ’ ধরনের (একাকী বা ছোট গ্রুপে সংগঠিত হয়ে আক্রমণ) আক্রমণ করার চেষ্টা আছে। এদের অল্প কিছু লোক সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া বা অন্য কোনো দেশে আছে। তারা অনলাইনে প্রচারণায় যুক্ত রয়েছে। দেশে কোনো ঘটনা ঘটলে অনলাইনে আইএসের নামে দায় স্বীকার করে প্রচারণা চালায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, দেশে এখন আইএসপন্থীদের সেভাবে কোনো নেতৃত্ব নেই। এই মতাদর্শীদের প্রচার, সদস্য সংগ্রহ ও যোগাযোগ—সবই চলছে অনলাইনে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন করে কথিত হিজরতের নামে ঘর ছাড়ার প্রবণতাও শুরু হয়েছে। এমন ঘরছাড়া দুই তরুণকে গত সোমবার পুলিশ ঢাকায় গ্রেপ্তার করেছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই জঙ্গিগোষ্ঠী গত এক বছরে দেশে ১০টির মতো ছোট ছোট বোমা হামলা করেছে। যার মধ্যে আটটিই হচ্ছে পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা। এর মধ্যে গত বছরের ২৯ এপ্রিল থেকে এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় ৮টি হামলার ঘটনায় আইএসের নামে দায় স্বীকারের খবর বেরিয়েছিল। এরপর গত মাসে ঢাকায় পুলিশের চেকপোস্টের পাশে ও নওগাঁয় মন্দিরে বোমা হামলা করে একই গোষ্ঠী।

সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর মাজারেও এই জঙ্গিগোষ্ঠী বোমা হামলার পরিকল্পনা করছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। এতে জড়িত পাঁচ জঙ্গিকে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পরদিন ১২ আগস্ট ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বলেছে, পাঁচজনই নব্য জেএমবির সামরিক শাখার সদস্য। সিটিটিসির প্রধান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেছেন, নব্য জেএমবির এই দল ২৩ জুলাই হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর মাজারে হামলার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু পুলিশের কড়া নজরদারিতে তারা ব্যর্থ হয়। এরপর ২৪ জুলাই ঢাকার পল্টনে পুলিশের চেকপোস্টের পাশে এবং ৩১ জুলাই নওগাঁ জেলার সাপাহার এলাকায় হিন্দুদের মন্দিরে বোমা হামলা করে। মনিরুল ইসলাম জানান, গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে যে তারা কথিত আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এসব হামলার পরিকল্পনা করেছিল। এই দলের আরও কয়েকজন সদস্য পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। তবে জঙ্গিদের এখন বড় হামলা করার সামর্থ্য নেই।

এর আগে গত মাসে দেশজুড়ে জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সারা দেশে পুলিশের সব ইউনিটে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছিল। তাতে পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। সেই সঙ্গে বলা হয়, দেশে হত্যাকাণ্ড-নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করছে নব্য জেএমবি।

দীর্ঘদিন জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোনোভাবেই জঙ্গিবাদ ইস্যুকে হালকা করে দেখা যাবে না। ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলে জঙ্গিদের উত্থানের আশঙ্কা রয়ে গেছে। আইএস সিরিয়ায় যুদ্ধে পরাজিত হলেও তাদের মতাদর্শ রয়ে গেছে। ইন্টারনেটে তাদের প্রচারণা বন্ধ হয়নি। এ দেশেও ওই মতাদর্শীদের তৎপরতা রয়েছে। আল–কায়েদা সীমিত আকারে হলেও পাকিস্তান–আফগানিস্তানে শক্তিমত্তার পরিচয় দিচ্ছে। উপমহাদেশে অতীতে এই সংগঠনের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক লক্ষ করা গেছে। এদের মতাদর্শীরা এ দেশেও নানা ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে—এটা মনে করার সুযোগ নেই। জঙ্গিরা এখন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ঝুঁকি রয়ে গেছে।