'নজরবন্দী' থাকার পর কাদের খান গ্রেপ্তার

গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ মনজুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলায় জাতীয় পার্টির (জাপা) কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান এবং ওই আসনের সাবেক সাংসদ আবদুল কাদের খানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ছয় দিন ‘নজরবন্দী’ রাখার পর বগুড়া শহরের রহমান নগরের বাড়ি থেকে গতকাল মঙ্গলবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বিকেল পাঁচটায় কাদের খানকে গ্রেপ্তারের অভিযানে গাইবান্ধা এবং বগুড়ার পোশাকধারী ও সাদাপোশাকের পুলিশের অর্ধশত সদস্য অংশ নেন।
কাদের খানকে কোন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, জানতে চাইলে বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এটা গাইবান্ধার পুলিশ বলতে পারবে। জানতে চাইলে সুন্দরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদ মনজুরুল হত্যা মামলায় কাদের খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত সোমবার ঢাকার আশুলিয়ায় এক অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেছিলেন, সাংসদ মনজুরুল হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের পুলিশ চিহ্নিত করেছে। শিগগিরই তাঁদের গ্রেপ্তার করে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হবে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র বলেছে, গত বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটা থেকে গাইবান্ধা ও বগুড়ার পুলিশ এবং গোয়েন্দারা বগুড়া শহরের রহমান নগরে কাদের খানের মালিকানাধীন বাড়ি ‘গরীব শাহ ক্লিনিক’ ঘিরে রাখে। ওই বাড়ির চতুর্থ তলায় সপরিবার বাস করেন তিনি। তাঁর গ্রামের বাড়ি সুন্দরগঞ্জের ছাপারহাটি গ্রামে। এভাবে ‘নজরবন্দী’ করার আগে বৃহস্পতিবারই তাঁর গাড়ির চালক আবদুল হান্নান, সুন্দরগঞ্জের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক শামিম হোসেন এবং দুই কর্মী মেহেদী হাসান ও শাহিনুর ইসলামকে আটক করে গাইবান্ধা পুলিশ। জব্দ করা হয় কাদের খানের মুঠোফোন। হান্নান ও শাহিনকে বগুড়া থেকে এবং মেহেদীকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-১ আসনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকে নির্বাচিত হন জাপার নেতা কাদের খান। এই আসনের সর্বশেষ সাংসদ মনজুরুল ইসলাম গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর নিজ বাড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হলে আসনটি শূন্য হয়। আগামী ২২ মার্চ এই আসনে অনুষ্ঠেয় উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে কাদের খান মনোনয়নপত্র তুলেছিলেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল। কিন্তু এর আগের দিন ‘নজরবন্দী’ কাদের খান মনোনয়নপত্র দাখিল না করার ঘোষণা দেন।
বৃহস্পতিবার থেকে পুলিশ ও গোয়েন্দারা কাদের খানের বাড়ির ভেতরে-বাইরে অবস্থান নিলে নানা গুঞ্জনের মধ্যে বগুড়া সদর থানার ওসি এমদাদ হোসেন দাবি করেছিলেন, জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় তাঁর নিরাপত্তার জন্যই এমন নজরদারি। পরে শনিবার গাইবান্ধার পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলামও একই রকম দাবি করেন।
সোমবার আইজিপির মন্তব্যের পরপরই দুপুর ১২টা থেকে কাদের খানের বাড়িতে গোয়েন্দা পুলিশের আনাগোনা বাড়ে। ‘গুজব’ ছড়িয়ে পড়ে, সাংসদ মনজুরুল হত্যা মামলায় তিনি যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হচ্ছেন। গণমাধ্যমকর্মীরা রাতভর বাড়িটির সামনে অপেক্ষা করেন। গতকাল বিকেল পাঁচটায় গাইবান্ধা পুলিশের বিশেষ শাখার দুই কর্মকর্তা মাহবুবর রহমান ও আতিকুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরা বাড়িতে ঢোকেন। দুই মিনিটের মধ্যে কাদের খানকে নিয়ে তাঁরা বেরিয়ে আসেন। গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে না দিয়ে দ্রুত একটি মাইক্রোবাসে তুলে বগুড়া সদর থানায় নেওয়া হয় তাঁকে।
এ সময় কাদের খানের স্ত্রী চিকিৎসক নাসিমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ বলেছে, কাদের খানকে একটি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গাইবান্ধার পুলিশ সুপারের কাছে নেওয়া হচ্ছে। তাঁকে আটক, নাকি গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তা কিছুই বলেনি। গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও দেখায়নি। তাঁকে নিয়ে যাওয়ার ১৫ মিনিট পর পুলিশ দীর্ঘক্ষণ ধরে বাসায় তল্লাশি চালিয়েছে। তবে কিছুই পায়নি।
গ্রেপ্তার অভিযানে অংশ নেওয়া গাইবান্ধা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মাহবুব বলেন, সাংসদ মনজুরুল হত্যা মামলায় কাদের খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একজন এএসপির নেতৃত্বে তাঁর বাসায় তল্লাশি চালানো হয়েছে।
গাড়িচালকসহ তিনজনের জবানবন্দি
সন্ধ্যায় গাইবান্ধার পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের বলেন, কাদের খানের গাড়িচালক আবদুল হান্নান, শাহিন ও মেহেদী সাংসদ মনজুরুল হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে গতকাল গাইবান্ধার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিলে রাত পৌনে নয়টার দিকে তাঁদের কারাগারে নেওয়া হয়।
মেহেদী ও শাহিনের বাড়ি সুন্দরগঞ্জের শ্রীপুর ইউনিয়নে। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কাদের খানকে আজ বুধবার আদালতে হাজির করা হতে পারে।
গতকাল গ্রেপ্তার হওয়ার আগে কাদের খান প্রথম আলোকে বলেন, গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মেহেদী ও শাহিন তাঁর বগুড়ার ক্লিনিকে আসেন। তিনি আগে থেকে তাঁদের চিনতেন না। ১২ জানুয়ারি মেহেদী ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসেন। সঙ্গে ছিলেন শাহিন। ক্লিনিকে সাত দিন চিকিৎসাধীন থাকাকালেই তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়। সুন্দরগঞ্জে বাড়ি হওয়ায় তাঁদের সঙ্গে এলাকার বিষয়ে হালকা আলাপ-আলোচনা হয়। ১৮ জানুয়ারি ছাড়পত্র নিয়ে চলে যান তাঁরা। এক মাস পর দেখা করতে পরামর্শ দেওয়া হয়।
কাদের খান বলেন, ‘ধারণা করছি, মেহেদী ও শাহিনকে নিয়ে কোনো ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছি। তাঁদের দিয়ে কোনো ঝামেলায় আমাকে জড়ানো হতে পারে।’ তিনি দাবি করেন, তিনি সাংসদ থাকাকালে মনজুরুলের সঙ্গে টিআর-কাবিখার বরাদ্দ নিয়ে একাধিকবার কথা হয়েছে। তবে মনজুরুল সাংসদ হওয়ার পর কখনো দেখা হয়নি বা কোনো বিষয়ে কথাও হয়নি। তাঁর সঙ্গে কোনো বিরোধও নেই।