'মনে হচ্ছিল, এই বুঝি মৃত্যু এল'

রাকিব হোসেন
রাকিব হোসেন

ইতালি উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন রাকিব হোসেন (২১)। হঠাৎ ঝড় ওঠে সাগরে। নৌকাটি পিছিয়ে আসতে শুরু করে। চার দিন দিগ্ভ্রান্ত হয়ে সাগরে ভাসতে থাকে। খাবার নেই, পানি নেই। রাকিবের মনে হচ্ছিল, এই বুঝি মৃত্যু এল। শেষমেশ দেখা মেলে উদ্ধারকারী এক জাহাজের। উদ্ধারের ২১ দিন পর তিউনিসিয়ায় নেওয়া হয়।

 রাকিব শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বাসিন্দা। গত ২১ জুন তিউনিসিয়া থেকে দেশে ফেরত আসা ১৭ বাংলাদেশির একজন তিনি। ভাগ্যের সন্ধানে দালাল ধরে ইউরোপে যাওয়ার জন্য এক বছর আগে তিনি দেশ ছেড়েছিলেন। সম্প্রতি বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জানালেন গত এক বছরের দুর্বিষহ জীবনকাহিনি।

রাকিবের বাবা আনিস মিয়া। কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ছাপাখানায় বাঁধাইয়ের কাজ করেন আনিস। পরিবার নিয়ে সেখানে থাকেন। অভাবের সংসার। পড়াশোনা বেশি এগোয়নি রাকিবের। ছাপাখানার কাজে যোগ দেন তিনিও। সংসারের অভাব দূর করতে রাকিবকে ইতালি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন বাবা আনিস মিয়া। কিশোরগঞ্জের উজ্জ্বল মিয়া নামের এক দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পাঁচ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। গত বছর রমজান মাসে রাকিবকে ব্যবসায়ী ভিসায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিয়ে যান উজ্জ্বল। শারজা ও আবুধাবিতে ২০ দিন রাখা হয়। এরপর মিসর হয়ে লিবিয়ায়। বেনগাজি শহরে ছয় দিন রাখা হয় রাকিবকে। এরপর বাসে করে নেওয়া হচ্ছিল ত্রিপোলিতে। পথে পুলিশ রাকিবকে আটক করে। মিসরতা শহরের কারাগারে থাকতে হয় ১৫ দিন। বুলেট নামের এক দালাল এক লাখ টাকা দিয়ে রাকিবকে কারামুক্ত করেন। ইতালিতে পাঠানোর দালাল চক্রের সদস্য বুলেটের বাড়ি গোপালগঞ্জে। চক্রটির কয়েকজনের সঙ্গে রাকিবের দেখা হয়। তাঁদের মধ্যে রাজন গোপালগঞ্জের, মোমিন ফরিদপুরের ও রাসেল মাদারীপুরের। ইতালিতে যাওয়ার জন্য চক্রটির সঙ্গে নতুন চুক্তি হয় রাকিবের। চুক্তি অনুযায়ী মাদারীপুর সদর উপজেলার মস্তফাপুরের এক নারীর কাছে তিন লাখ টাকা পৌঁছে দেন রাকিবের বাবা আনিস। টাকা পাওয়ার পর দালাল চক্রটি রাকিবের পাসপোর্ট কেড়ে নেয়। তাঁকে ছয় মাস ত্রিপোলিতে আটকে রাখে। পরে সাগরপারের একটি দ্বীপে আরও চার মাস। সেখান থেকে আরেকটি দ্বীপে নেওয়া হয়। এরপর ছোট ট্রলারে করে ভূমধ্যসাগরে নামিয়ে দেওয়া হয়। ইঞ্জিনচালিত ট্রলারটিতে রাকিবসহ ৫০-৬০ জন ওঠেন। ট্রলারটি ইতালির উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ ঝড়ের হানা। 

অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে গত মে মাসের শুরুতে ভূমধ্যসাগরে মারা গেছেন ৩৯ বাংলাদেশি। একই মাসের শেষ দিকে তিউনিসিয়া উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৬৪ বাংলাদেশিকে। ফিরে আসা ব্যক্তিরা বলেছেন তাঁদের দুঃসহ সেই যাত্রার কথা।

রাকিব বলেন, ‘একটি বছর ছিল দুর্বিষহ জীবন। দালালেরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দিত না। মাঝেমধ্যে খাবার দিত না। মারধর করত। ট্রলারে ওঠার আগে ৪-৫ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছিল। চার দিন আমরা সাগরে ভেসেছি। কোনো খাবার ছিল না; পানিও ছিল না। সাগরের লোনা পানি খেয়ে বেঁচে ছিলাম। সারাক্ষণ মনে হতো, এই বুঝি মৃত্যু এল।’

সাগরে ভাসার চতুর্থ দিনে একটি জাহাজের দেখা পান রাকিবরা। সেটি রাকিবদের উদ্ধার করে। ২১ দিন ওই জাহাজেই ছিলেন। এরপর তিউনিসিয়ায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে বাংলাদেশে। ২১ জুন ঢাকায় রাকিবকে গ্রহণ করে তাঁর পরিবার। এরপর চলে যান ভৈরবে। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে যাওয়ার জায়গা নেই। নড়িয়ার পশ্চিম লোনসিং গ্রামে বাড়ি। ৮ শতাংশ জমিতে বসতবাড়ি ছিল রাকিবদের। তাঁকে ইতালি পাঠানোর জন্য ৯ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।।

নড়িয়া থানার ওসি মঞ্জুরুল হক আকন্দ বলেন, এর আগে ভূমধ্যসাগরে ট্রলারডুবিতে হতাহতের ঘটনায় সম্প্রতি নড়িয়া থানায় মানব পাচারের মামলা করেছে একটি পরিবার। কিন্তু ওই মামলায় রাকিবের সঙ্গে প্রতারণা করা ব্যক্তিদের কারও নাম নেই।