পানের গ্রাম পূর্ব হিঙ্গুলী, ৪৫ চাষি ধরে রেখেছেন শত বছরের ঐতিহ্য
পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট গ্রাম। যেদিকে চোখ যায়, বাঁশের খুঁটির ওপর শণের ছাউনি দেওয়া সারি সারি পানের বরজ। শ্রমিক, কৃষক মিলিয়ে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পান চাষের সঙ্গে জড়িত। আয়ের উৎসও পান চাষ। পানের গ্রাম হিসেবে পরিচিত এই গ্রামের নাম পূর্ব হিঙ্গুলী। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার হিঙ্গুলী ইউনিয়নে গ্রামটির অবস্থান।
মিরসরাই উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব হিঙ্গুলী গ্রামে প্রায় শত বছর ধরে পান চাষ হয়। এখানকার ঝাল পানের চাহিদা থাকায় সরবরাহ হয় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। গতকাল শনিবার বিকেলে ওই গ্রামে গেলে কথা হয় পানচাষিদের সঙ্গে। তাঁদের কাছ থেকে জানা গেল, একসময় মিরসরাই উপজেলাজুড়েই পানের চাষ হতো। তবে চাষের উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, পুঁজির সংকট, বিরূপ আবহাওয়া আর রোগবালাইয়ের ঝক্কি সামলে উঠতে না পেরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার চাষিরা পান চাষ ছেড়ে দিয়েছেন। তবু নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পূর্ব হিঙ্গুলী গ্রামের ৪৫ জন কৃষক এখনো ধরে রেখেছেন পান চাষের ঐতিহ্য। এখানে ছোট–বড় মিলিয়ে ৫০টির মতো পানের বরজ রয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিরসরাই উপজেলায় পাঁচ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়। তার পুরোটাই হয় হিঙ্গুলী ইউনিয়ন এলাকায়। সরকারি তালিকায় ২০ জন চাষি থাকলেও এ এলাকায় এখনো ৪৫ জন কৃষক পান চাষের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
গতকাল বিকেলে উপজেলার পূর্ব হিঙ্গুলী গ্রামের একটি পানের বরজের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় পানচাষি নারায়ণ চন্দ্র আইচের সঙ্গে। বাবা নেপাল চন্দ্র আইচের হাত ধরে পান চাষ শিখে ১৯ বছর ধরে পানের বরজ করছেন তিনি। এ কৃষক বলেন, ‘পান খুব যত্নের ফসল। সব সময় লেগে থাকতে হয় বরজে। এখন চাষের খরচ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। আমার দেড় বিঘা জমিতে পানের চাষ আছে। এ জমি আবাদে বছরে এক লাখ টাকার মতো খরচ হয়। বাজারে ৭২টির পানের (এক বিড়া) এক আঁটি বিক্রি হয় ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। হিসাব কষলে দেখা যায়, সব খরচ বাদ দিয়ে সংসার চালানোর টাকা থাকে। সঞ্চয় থাকে না। তবু বাবা–দাদার ঐতিহ্য, তাই ধরে রেখেছি।’
পানচাষি নারায়ণ চন্দ্র আইচ অভিযোগ করে বলেন, ‘অন্যান্য ফসল চাষে কৃষি বিভাগ নানা প্রণোদনা দিলেও পানচাষিদের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয় না কখনো। সহজ শর্তে কোনো ঋণের ব্যবস্থাও নেই আমাদের জন্য। পুঁজির সংকট খুব ভোগায়।’
হিঙ্গুলী ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা মিরসরাই উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা কণিকা রানী মজুমদার বলেন, ‘সুযোগ না থাকায় পানচাষিদের পরামর্শ ছাড়া অন্য কোনো সহযোগিতা দিতে পারি না। তবু চাষ বাড়াতে তাঁদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি।’
পূর্ব হিঙ্গুলী এলাকার প্রবীণ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক নটবর দত্ত। এ এলাকায় পান চাষ সম্পর্কে ভালো জানাশোনা তাঁর। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বয়স ৭০ পেরিয়েছে। বাবা–দাদা সবাইকে পান চাষ করতে দেখেছি। সে হিসাবে এ এলাকায় পান চাষের বয়স ১০০ বছরেরও বেশি হবে। একসময় এ এলাকায় শত শত পানের বরজ ছিল। পান চাষ ছিল এখানকার সব মানুষের পেশা। এখন চাষ উপকরণের দাম বাড়ায় শিল্পটি বিলুপ্তির পথে। শুধু ভূমিহীন কিছু কৃষকের হাতে এখনো টিকে আছে শতবর্ষী এ কৃষি ঐতিহ্য। সরকার সহযোগিতা দিলে এখনো এ শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব।’
মিরসরাইয়ে পান চাষ ও চাষিদের সংকটের বিষয়ে মিরসরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র নাথ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিরসরাইয়ে পান চাষের শত বছরের ইতিহাস রয়েছে। নানা সংকট মোকাবিলা করে হিঙ্গুলী এলাকায় এখনো কিছু পানচাষি টিকে আছেন। পান চাষ নিয়ে সরকারি কোনো প্রকল্প না থাকায় আমরা চাষিদের সার, ওষুধ বা আর্থিক কোনো সহযোগিতা দিতে পারি না। তবে সব সময় পানচাষিদের নানা পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়।’