‘সুন্দরম’–এর সবাই সুন্দর

নৈঃশব্দ্য একাত্তর নাটকে মঞ্চে সুন্দরম নাট্যদলের শিল্পীরা
ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের সময় নিরন্ন গ্রামবাসী নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটছেন একজনের ভরসায়। পথ দেখিয়ে নিচ্ছেন দুই পা-বিহীন একজন মানুষ। এটি ২০২২ সালে মঞ্চস্থ হওয়া নৈঃশব্দে৵ একাত্তর নাটকের একটি দৃশ্য। বাস্তব জীবনেও নূর মোহাম্মদ হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী। এ নাটকের অভিনয়শিল্পীরা প্রতিবন্ধী। দৃষ্টিজয়ী, দুই পা নেই অথবা বাক্প্রতিবন্ধী।

অথচ মঞ্চে তাঁরাই হয়ে উঠেছেন একেকজন দুর্দান্ত অভিনেতা। কখনো গ্রামবাসীকে বিপদে সহযোগিতা করছেন, মঞ্চে কখনো তাঁদের মুখে উঠে আসছে সমাজকাঠামোর দুর্বলতার কথা। কখনো তাঁদেরই কেউ হয়ে উঠছেন বিশ্বসাহিত্যের ক্ল্যাসিক চরিত্র রোমিও, জুলিয়েট।

আ ডিফারেন্ট রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট, ফিয়ারলেস ও নৈঃশব্দে৵ একাত্তর—এ তিনটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে এই প্রতিবন্ধী শিল্পীদের অভিনয়ে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে স্বাভাবিক জীবনযাপনের পাশাপাশি তাঁরা নিজেদের প্রস্তুত করছেন মঞ্চনাটকের মতো শ্রমসাধ্য শিল্পমাধ্যমের জন্য।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর চলছিল ব্রিটিশ কাউন্সিলে প্রতিবন্ধী শিল্পীদের এক কর্মশালা। হঠাৎ প্রবেশ করে দেখা গেল, বড় মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রতিবন্ধী শিল্পীরা একেকজন ভিন্ন ভিন্ন রূপে স্থির হয়ে আছেন। দৃষ্টিজয়ী লাভলী খাতুন, বাক্‌প্রতিবন্ধী রাকিব অথবা পা-বিহীন আবদুল্লাহ আল মামুন গ্রামবাংলার ঢেঁকি, শিয়াল অথবা ইঁদুর সেজেছেন। প্রশিক্ষক এষা ইউসুফের নির্দেশ আসার আগপর্যন্ত এভাবেই স্থির থাকতে হবে শিল্পীদের।

সঙ্গে আছেন ইশারা ভাষার সাহায্যকারী। শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কেউ জন্ম থেকে দৃষ্টিহীন, কারও পা হারিয়েছে দুর্ঘটনায়। রুমা খান কাজলের দৃষ্টি হারায় ভাইদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ানোর সময় পুরান ঢাকার একটি বাড়ির ছাদ থেকে নিচে পড়ে। দুই চোখের রেটিনা ছিঁড়ে যায় কাজলের। খুব সুন্দর গান গাইতে পারেন লাভলী খাতুন। মেঝেতে পয়সা পড়ে গেলে তিনি কান পেতে শুনে বুঝতে চেষ্টা করেন, কোন দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে।

সেদিন দুপুরে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী দেলোয়ার গর্ব করে জানালেন, তিনি নিজের দুই হাতের তালু ব্যবহার করে কক্সবাজারের পাহাড়েও উঠেছেন। তবে একটা আক্ষেপ সবারই আছে। ঢাকা শহরের পথে চলাচলে অসুবিধা হয়। গণপরিবহন বা সড়ক—কোনোটিই প্রতিবন্ধীদের জন্য সহজ নয়। আছে পকেট খরচের মাথাব্যথা। কারও বাড়ির সামর্থ্যই তেমন আহামরি কিছু নয়। এত প্রতিকূলতা নিয়েও তাঁরা নাটকের জন্য অনুশীলন করে চলেছেন।

প্রতিবন্ধী শিল্পীদের সবাই ঢাকা থিয়েটারের অঙ্গসংগঠন ‘সুন্দরম’-এর শিল্পী। মুক্তিযোদ্ধা, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ প্রথম আলোকে বললেন, প্রতিবন্ধী শিল্পীদের নিয়ে তৈরি সংগঠনটির নাম সুন্দরম হওয়ার পেছনে একটা ভাবনা আছে।

এসব মানুষ সবাই সুন্দর, তাঁদের সে অনুভব দিতেই সুন্দরম শব্দটির ব্যবহার। তিনি জানান, আগামী বছর প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে পারে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী নাট্য উৎসব’। এর জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি প্রয়োজন। এখন চলছে ‘ডিয়ার’ প্রকল্পের কর্মশালা।

ডিয়ার (ডিজঅ্যাবিলিটি আর্টস রি-ডিফাইনিং এমপাওয়ারমেন্ট) হচ্ছে ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে অংশীদারত্বে ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটি প্রকল্প, যেটি শুরু হয় ২০১৯ সালে। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও শিল্পকলার মধ্যে সম্পর্ক তৈরি এর উদ্দেশ্য। এ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে সামাজিক ভ্রান্ত ধারণা দূর হবে এবং সামাজিকভাবে তাঁদের আরও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

ব্রিটিশ কাউন্সিলের আর্টস প্রোগ্রাম ম্যানেজার সৌরদীপ দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম থেকেই ঢাকা থিয়েটার ও ব্রিটিশ কাউন্সিল যৌথভাবে কাজগুলো করে আসছে। ২০১৬ সালে তাদের নিয়ে আ ডিফারেন্ট রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট মঞ্চস্থ করাতে ইংল্যান্ডের গ্রে থিয়েটারের বিখ্যাত নাট্য নির্দেশক জেনি সিলিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে ব্রিটিশ কাউন্সিল। তাঁরই পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় নাটকটি।

অন্য ভাষার নির্দেশকদের নির্দেশনা বাংলায় করে নির্দেশ দিতে হয় বলে জানালেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে শেক্‌সপিয়ারের জন্মের ৪৫০ বছর উদ্‌যাপন উপলক্ষে ইংল্যান্ডে ৩৭টি নাটকের সঙ্গে ইশারা ভাষায় নাটক মঞ্চস্থ হয়। সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। তখন থেকে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করার ভাবনা শুরু হয়। শুরু থেকেই ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে আছে ব্রিটিশ কাউন্সিল।’

২৩ সেপ্টেম্বর দিনব্যাপী এই দলের কর্মশালায় উপস্থিত থেকে ফিরে আসার সময় ছিল পরিচয়ের পর্ব। উচ্চতা, গায়ের রং ও পোশাকের বর্ণনা শুনে দৃষ্টিজয়ী শিল্পীরা ধারণা করে নেন, মানুষটি দেখতে কেমন।

নিজের সম্পর্কে দু-একটা কথা বলার পর্বে হুইলচেয়ারবন্দী সেই নূর মোহাম্মদ এগিয়ে এলেন কথা বলতে। তিনি জানান, দুই পা নেই, তবে দুই হাত দিয়েই তিনি দ্রুত সাঁতার কাটতে পারেন। আড়াই মিনিটের কম সময়ে অতিক্রম করতে পারেন ৫০ মিটার। নূর, কাজল, রাকিব—তাঁরা সবাই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী, তবে একেকজন জীবনজয়ী শিল্পী।