পানি, পাতা, চা, চানাচুর হাতের কাছে যা পান, তা দিয়েই আঁকেন ছবি

পানি, চা, কফি, পাতা, ইট, কয়লা, দাঁতের মাজন—হাতের কাছে যখন যা পান, তা দিয়েই শিল্পী আর. করিম এঁকে চলেছেন একের পর এক ছবিছবি: শিল্পীর ফেসবুক থেকে কোলাজ

কদমপাতা বা মেহগনিপাতার মাঝখানে বসে আছে দোয়েল পাখি। মনে হয় যেন এখনই ডানা মেলে উড়ে যাবে। চায়ের দোকানের টেবিলে থাকা জগের পানিতে ফুটে উঠেছে কাজী নজরুল ইসলামের মুখ। চা দিয়ে আঁকা রবীন্দ্রনাথের মুখচ্ছবি স্পষ্ট চেনা যায়। কফি দিয়ে আঁকা মান্না দে যেন এখনই গেয়ে উঠবেন গান।

পাতার মাঝখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখচ্ছবি দেখে চমকে উঠতে হয়। মনে হয় এই যেন তিনি তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ শুরু করবেন। এভাবেই পানি, চা, কফি, পাতা, ইট, কয়লা, দাঁতের মাজন—হাতের কাছে যখন যা পান, তা দিয়েই শিল্পী আর. করিম এঁকে চলেছেন একের পর এক ছবি।

পানের দোকানে বসে দোকান থেকে পান নিয়ে তা দিয়েই বানিয়েছেন ঝুঁটিওয়ালা মোরগ। চানাচুর খেতে বসে চানাচুর দিয়ে বানিয়েছেন ডালে বসা পাখি। দাঁতের কালো মাজন দিয়ে এঁকেছেন গাছের ডালে বসা দুটি পাখি। বাড়ির উঠান থেকে কুড়িয়ে পাওয়া পাতায় চিংড়ি, ধানখেতে বসে ক্যানভাসে রংতুলিতে ধানখেতের ছবি, কয়লা দিয়ে দেয়ালে আঁকা আবদুল কুদ্দুস বয়াতি অথবা লাল, কালো, বেগুনি, সবুজ বলপেন দিয়ে বিভিন্ন বাণী লিখে তা দিয়েই এঁকেছেন বিখ্যাত কারও অবয়ব।

শুধু তা–ই নয়, ফেলে দেওয়া সবজি ও ফল দিয়ে বানাচ্ছেন নানা শিল্পকর্ম। কত ছবি এঁকেছেন, তার সঠিক হিসাব দিতে না পারলেও জানালেন কম করে হলেও পাঁচ হাজার ছবি এঁকেছেন। পানি ও চা দিয়ে বানানো অনেক ছবি সংরক্ষণ করা সম্ভব নয় বলে সেগুলোর ছবি তুলে রেখেছেন।

পাঞ্জাবিতে নকশা করা, বিয়েবাড়িতে আলপনা আঁকাসহ অন্যান্য আঁকাআঁকি তো আছেই। শিক্ষাসনদে আর. করিমের নাম রেজাউল করিম। তবে আঁকাআঁকির ক্ষেত্রে তিনি ‘আর. করিম’ নামেই পরিচিত।

চা দিয়ে আঁকা রবীন্দ্রনাথ
ছবি: শিল্পীর ফেসবুক থেকে

আর. করিমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা কক্সবাজারের মহেশখালীর বাঁকে। সেখানেই থাকেন তিনি। ১৯৯৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জন্ম। আঁকাআঁকি নিয়ে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। বাবা মোস্তাক আহম্মেদ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। মা খালেদা বেগম গৃহিণী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে আর. করিমই শুধু আঁকাআঁকির সঙ্গে যুক্ত।

ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকেন আর. করিম। চারুকলায় পড়ার ইচ্ছা থাকলেও সে সময় পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে পড়া সম্ভব হয়নি। চারুকলায় পড়তে পারেননি, তা নিয়ে একটা সময় খুব আক্ষেপ ছিল। কিন্তু এখন আর আক্ষেপ হয় না। বললেন, ‘এখন মনে হয় যদি ছবিই আঁকতে না পারতাম, এই লাইনের কেউ না হতাম, সেটাই অনেক বড় আক্ষেপের কারণ হতো।’ গত বুধবার মুঠোফোনে কথা হলো এই শিল্পীর সঙ্গে।

চায়ের টেবিলে পানি দিয়ে আঁকা কাজী নজরুল ইসলাম
ছবি: শিল্পীর ফেসবুক থেকে

মহেশখালী কে জি অ্যান্ড প্রিক্যাডেট স্কুলে প্রথম ভর্তি হলেও আর্থিক কারণে পরে স্কুল পরিবর্তন করে মহেশখালী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়েছিল আর. করিমকে। আর. করিমের ভাষায়, সরকারি এই স্কুলেই তাঁর সামনে বিশাল দুয়ার খুলে যায়। স্কুলের পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমেই শিল্পী হাশেম খানের অলংকরণের সঙ্গে পরিচিতি ঘটে। পাঠ্যবইয়ের মধ্যে থাকা ছবিগুলোই দেখে দেখে আঁকতে শুরু করেন আর. করিম। বললেন, ‘কত দূর এলাম জানি না, তবে এই পর্যন্ত এলাম। একটু হলেও মানুষ আমাকে চেনেন।’

শিল্পী হাশেম খান, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকসহ বড় বড় শিল্পীর সান্নিধ্য পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন আর. করিম। সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গেও যোগাযোগ ঘটেছে। এগুলো তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। আবারও বললেন, ‘আমি গুণীজনদের কাছ থেকে শিখি, শুধু শিখি।’

পাতার মাঝে শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: শিল্পীর ফেসবুক থেকে

শিল্প নির্দিষ্ট মাধ্যমে সীমাবদ্ধ থাকবে—এটা মানতে পারেন না আর. করিম। তাঁর মতে, কোনো কিছু সৃষ্টি করতে চাইলে মাধ্যম কোনো ব্যাপার না। মনের আনন্দে আঁকতে হবে। তাই আঁকাআঁকিকে পেশা হিসেবে নিতে পারেননি। এটি তাঁর নেশা হিসেবেই রয়ে গেছে। বললেন, ‘আমার এখন মনে হয় আঁকাআঁকি ছাড়া আমাকে দিয়ে আর কোনো কাজ হবে না। এ আঁকাআঁকি আমাকে দিয়েছে অনেক কিছু। আঁকাআকিতে আমি শুধু যাপন করি না, উদ্‌যাপনও করি বৈকি। সব সময় শিল্পের সঙ্গে থাকি।’

আর. করিম জানালেন, সমকালীন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর তিনটি বইয়ের ফ্ল্যাপে তাঁর আঁকা মুখাবয়ব ব্যবহার করছেন। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও লেখকের বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণের কাজ করেছেন। মান্না দের ছবি এঁকেছেন দুই শতাধিক। এটা অনুরাগের জায়গা থেকে করেছেন।

কক্সবাজার আর্ট ক্লাব আয়োজিত রোহিঙ্গাদের সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী ‘মানবতার জন্য শিল্প-২০১৭’, আইডব্লিউএস আয়োজিত বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক জলরং প্রদর্শনী-২০১৮, কক্সবাজার আর্ট ক্লাব আয়োজিত সম্প্রীতি সমাবেশ উপলক্ষে যৌথ চিত্র প্রদর্শনী-২০১৯–সহ বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নিয়েছেন আর. করিম।

পাতার মাঝে দোয়েল পাখি। মনে হয় যেন এখনই উড়ে যাবে
ছবি: শিল্পীর ফেসবুক থেকে

আর. করিম জানান, এখনো তাঁদের পরিবার আর্থিকভাবে খুব সচ্ছল, তা বলা যাবে না। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। বাবা, মাসহ অন্য ভাইয়েরা একসঙ্গে থাকেন। বড় ভাই সিরাজুল মোস্তফা একটি মসজিদে ইমামতি করেন। মূলত, তাঁর কাঁধেই সংসারের দায়িত্ব।

কফি দিয়ে আঁকা মান্না দে
ছবি: শিল্পীর ফেসবুক থেকে

সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক করেছেন আর. করিম। বললেন, কেউ ভালোবেসে অথবা হুট করে তাঁর আঁকা ছবি কেনেন। কোনো মাসে হয়তো ২০ হাজার টাকা আয় করেন আবার কোনো মাসে ৫ হাজার। যা–ই পান, সংসারে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেন।

বিত্তবান হওয়ার স্বপ্ন দেখেন না আর. করিম। স্বপ্ন দেখেন তিনি যে কাজ করেন, তার উন্নয়ন করে ভিন্নধারার শিল্পী হিসেবে সুনাম কুড়াবেন একদিন। বললেন, ‘বড়লোক হলেও তো মানুষ তিন বেলা খাবারই খান, এর বেশি তো আর খেতে পারবেন না।’ আরও বললেন, ‘আমি আমার মতো করেই জীবনটাকে যাপন করতে চাই। এই সমাজের জন্য অবশ্য এই চাওয়া পূরণ করা কঠিন। কেননা, পরিবার বা আশপাশের মানুষের প্রত্যাশা তো অনেক।’

কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের সঙ্গে শিল্পী আর. করিম
ছবি: শিল্পীর ফেসবুক থেকে

পরিবারের আর্থিক অবস্থা, সংরক্ষণশীল পরিবার ও সমাজে প্রথম দিকে তাঁর এই আঁকাআঁকি অনেকেই পছন্দ করেননি। আঁকাআঁকি করা অনেকটা বিলাসিতার মতো ছিল। তবে তিনি তাঁর মতো করেই এঁকে চলেছেন। জানালেন, তাঁর পাঁচ হাজারের অধিক শিল্পকর্মের মধ্যে অর্ধেক মানুষের মুখের ছবি আর বাকি অর্ধেক প্রাকৃতিক দৃশ্য, সমসাময়িক বিষয় নিয়ে। বিশেষ করে মানুষের মুখ তাঁকে খুব আকর্ষণ করে।

পাতা দিয়ে বানানো সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের প্রতিকৃতি
ছবি: শিল্পীর ফেসবুক থেকে

আর. করিম নিজেকে রংতুলির মানুষ, আঁকাআঁকির মানুষ অথবা বাস্তববাদী স্বাপ্নিক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। স্বপ্ন দেখেন সুন্দর আগামীর। তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা একটাই—শুধুই এঁকে যাওয়া। তাঁর মতে, কাজে সততা থাকলে সেই কাজই তাঁকে মানুষের কাছে পরিচিত করবে।

ফেলনা চামচ দিয়ে বানানো বক
ছবি: শিল্পীর ফেসবুক থেকে

আর. করিম বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, মহেশখালী উপজেলা শাখার একজন সদস্য। এ ছাড়া বেশ কিছু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত।

ফেলনা সবজি দিয়ে বানানো শিল্পকর্ম
ছবি: শিল্পীর ফেসবুক থেকে

তিনি এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন, যেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামি, শ্রেণিবৈষম্য, হানাহানি, নারীর সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, দালালি, শান্তির নামে ধোঁকাবাজি, পুঁজিবাদ, গুম, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও কুসংস্কার থাকবে না। তাঁর মতে, বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরার ক্ষমতা তরুণ প্রজন্মের আছে। শুধু প্রয়োজন সদিচ্ছার।