সাক্ষাৎকার: রফিকুন নবী

‘আমাদের মতো এই সুন্দর দেশ আর দুটি পাওয়া যাবে না’

শিল্পী রফিকুন নবী চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট, শিল্পসমালোচক, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক ও চিত্রকলার শিক্ষক। বহুমুখী প্রতিভার এই শিল্পীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জে। শিল্পকলায় অনন্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৩ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়া পেয়েছেন চারুকলায় জাতীয় সম্মাননা শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার। শিল্পী রফিকুন নবী বেশি পরিচিত রনবী নামে। পত্রপত্রিকায় এই নামে তাঁর কার্টুন দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁর রনবী নামও ছড়িয়ে পড়ে একই সঙ্গে। ‘টোকাই’ চরিত্র রনবীর অনন্য এক সৃষ্টি।

 রফিকুন নবীর ভিডিও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক। এখানে থাকল তার শ্রুতলিখন।

আনিসুল হক:

বাংলাদেশের চিত্রকলা শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ, আমাদের মাস্টার পেইন্টারদের একজন শিল্পগুরু রফিকুন নবী। শিল্পী রফিকুন নবী এবং কার্টুনিস্ট রনবী যে একই ব্যক্তি, তা আমরা সবাই জানি। আবার ছড়া লেখা, রম্যরচনা লেখা, স্মৃতিকথার বই, ভ্রমণকাহিনি লেখা—সব মিলিয়ে আমি বলব যে বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির জগতে এক উজ্জ্বলতম নাম রফিকুন নবী। আমাদের পথিকৃৎ শিল্পী। আমাদের এই অনুষ্ঠানের নাম আমরা দিয়েছি ‘অভিজ্ঞতার আলো’। দর্শকমণ্ডলী, আপনাদের সবাইকে প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল এবং অন্যত্র রফিকুন নবীর এই বিশেষ আলাপচারিতার অনুষ্ঠানে স্বাগত জানাচ্ছি।

প্রথমেই স্যারকে বলি, ১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর আপনার জন্ম। এটা কি চাঁপাইনবাবগঞ্জে?

রফিকুন নবী: চাঁপাইনবাবগঞ্জে।

আনিসুল হক:

আপনার বাবা রশিদুন নবী পুলিশ অফিসার ছিলেন। আপনি কত বছর বয়সে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়লেন?

 রফিকুন নবী: ওভাবে বলতে গেলে, ছেড়ে দিয়েছি বলা যাবে না। এখনো আছি। প্রায়ই যাই, যাওয়া-আসা করি। তবে নিভৃতে যাই। নিজের যেটুকু আছে, ছোটখাটো ঘরবাড়ি, সেখানে যাই একটু বিশ্রাম করতে। তারপর চলে আসি। খুব কারও সঙ্গে যে মেশামেশি আছে, তা-ও না। কিন্তু নিয়মিত যাতায়াত আছে।

আনিসুল হক:

আপনার শৈশব কাটল পুরান ঢাকায়?

 রফিকুন নবী: আমার বাবার বদলির চাকরি ছিল। এই বদলির চাকরির কারণে পুরান ঢাকায় থিতু হলাম ১৯৫২ সালের মাঝামাঝি। ঢাকা শহর তখন ওই ভাষা আন্দোলনের ঠিক পরবর্তী সময়ের উত্তাল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ওই সময় আমরা বাইরে থেকে এলাম। আগস্ট কিংবা সেপ্টেম্বরে এসে ঢুকলাম। সেই যে ঢুকলাম ঢাকায়, ওইটাই ফাইনাল হয়ে গেল।

আরও পড়ুন
কথা বলার এক মুহূর্তে রফিকুন নবী
ফাইল ছবি: প্রথম আলো
আনিসুল হক:

১৯৫২ বা ১৯৫৪ সালে অথবা ’৫০-এর দশক বা ’৬০-এর দশকে ঢাকা তো শহর খুব সুন্দর ছিল।

রফিকুন নবী: হ্যাঁ। ছোটখাটো শহর। ঢাকা বলতে তখন একটা অন্য ধরনের ফিলিংস ছিল আমাদের। আমরা পোস্তগোলা থেকে সাইকেল চালিয়ে নবাবগঞ্জ পর্যন্ত, নবাবগঞ্জ মানে লালবাগ, নবাবগঞ্জ, হাজারীবাগ পর্যন্ত আসতে এবং ফেরত যেতে ৪৭ মিনিট লাগত সাইকেলে। এটা আমরা নিয়মিত করতাম ছোটবেলায়, সেভেন-এইটে পড়ার সময়। এটা ছিল এতই ছোট এদিকে। আর আড়াআড়িতে উত্তর-দক্ষিণে তো আরও ছোট। নবাবপুরের রেলগেট এখানে শেষ। পরে টিকাটুলি, হাটখোলা এদিক দিয়ে এসে শেষ হয়। এদিকে এসএম হলটা শুধু রেললাইনের এপারে চলে এসেছিল। হাতিরপুল হয়ে রেললাইন ভাগ করে পুরান ঢাকা আর নতুন শহর তৈরি হচ্ছে তখন ধীরে ধীরে। তো এই পর্যায়ে আমি তখন ঢাকায় রয়েছি। আর বাবার বদলির চাকরির কারণে আমার জন্য খুব মজার সময় কেটেছে। সেই অভিজ্ঞতাগুলো এখন অনেক কাজে দেয়। বাবা ওসি দিয়ে শুরু করেছিলেন। এ কারণে এক এক থানায় যেতেন তিনি। সেখানকার ল্যান্ডস্কেপ, সেখানকার মানুষ, সেখানকার ফুল, ফসল—সবকিছুই অদ্ভুত ছিল। এই পরিবর্তনগুলো আমরা আপাতদৃষ্টে বুঝি না, কিন্তু কাছাকাছি।

আনিসুল হক:

কোন কোন জেলায় গেলেন, তা মনে আছে?

রফিকুন নবী: হ্যাঁ, প্রথম ছিলাম রাজশাহীতে। বাবার চাকরির শুরুতে। আমার জন্ম ওনার চাকরির প্রায় কাছাকাছি সময়ে ছিল। রাজশাহীর পাশে পবা থানায় ছিলাম। একটু একটু মনে আছে। তারপর গেলাম সিংড়া থানায়। এটি চলনবিলের ধারে। চলনবিলে বিরাট বড় বড় মাছ পাওয়া যেত। থানার কাছাকাছি যে ল্যান্ডস্কেপ, সেখানকার মানুষগুলোকে দেখেছি। জীবজন্তু, বড় বড় গুইসাপ—কী বলি—থানার মধ্যে যা-ই হোক, এ রকম সব জায়গায় ছিলাম। তারপর বদলি হয়ে চলে এলাম ফতুল্লায়। ফতুল্লাতে যখন ছিলাম, তখন দেশ ভাগ হচ্ছে।

আনিসুল হক:

ফতুল্লায় থাকার সময় দেশ ভাগ হচ্ছে—১৯৪৭ সালে?

 রফিকুন নবী: হ্যাঁ। তখন পাকিস্তান হলো আরকি। তখন খুব ছোট ছিলাম, অত মনে নেই, খণ্ড খণ্ড মিছিল বের হতো। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ইত্যাদি স্লোগান শুনতাম। আর শুধু দেশাত্মবোধক গান হতো তখন। আর শচীন সেনগুপ্তর ‘সিরাজ উদদৌলা’ নাটক—ওই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা—জীবনে প্রথম ওই নাটকটা দেখি। যা হোক, সেখানকার স্মৃতি। তারপর ট্রান্সফার হয়ে চলে গেলেন বিক্রমপুরের লৌহজংয়ে। সেখানকার বড় স্মৃতি হলো ’৫০-এর ভূমিকম্প, আসামে। সেই সময় এখানেও কিন্তু বড় ভূমিকম্প হয়েছিল।

 সেই সময় পুরো মাটি কাঁপছিল। বাসার সামনে বড় দিঘি ছিল, সেটার পানি সমুদ্রের পানির মতো উথলে চারদিকে চলে যাচ্ছিল। ওই কাঁপাকাঁপির মধ্যে মানুষজন মাছ ধরতে ব্যস্ত! মাছ বেরিয়ে আসছিল। এগুলো অনেক মজার স্মৃতি। এগুলো তো বললে অনেক ডিটেইলে যাওয়া যায়। এক একটা জায়গা নিয়ে অনেক কিছু বলা যায়। সেখানে থাকলাম। সেখানে (লৌহজং) দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে লেখাপড়া শুরু হলো। প্রথম শ্রেণি শুরু হয়েছিল ফতুল্লায়, আদর্শলিপি দিয়ে।

আনিসুল হক:

তারপর পুরান ঢাকায় এসে কোন ক্লাসে ভর্তি হলেন?

রফিকুন নবী: ক্লাস ফোরে ভর্তি হলাম।

আনিসুল হক:

কোন স্কুলে স্যার?

রফিকুন নবী: পোগোজ হাইস্কুল। সেটাকে আগে বলা হতো পোগোজ ইংলিশ হাইস্কুল।

আনিসুল হক:

 তাহলে আপনাদের কি শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি ছিল?

রফিকুন নবী: না।

শিল্পকলায় অনন্য অবদানের জন্য রফিকুন নবী ১৯৯৩ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়া পেয়েছেন চারুকলায় জাতীয় সম্মাননা শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার
ফাইল ছবি: প্রথম আলো
আনিসুল হক:

 ছবি আঁকাটা কি তখনো চলত?

 রফিকুন নবী: সেটা তো ছেলেবেলা থেকেই। বাবা ছবি আঁকতেন। পুলিশ হলেও আর্ট কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছিলেন, কলকাতায় ভর্তি হবেন। সেই সময় তাঁর বাবা মানে আমার দাদা মারা গেলেন। এতে সব ওলট-পালট হয়ে গেল। উনি আর ভর্তি হতে পারলেন না। আমার দাদির একমাত্র ছেলে, তখন ‘হচপচ’ লেগে গেল, সেখানে আর ভর্তি হওয়া হলো না। তখন কোটা সিস্টেম ছিল—বাবা যদি পুলিশ অফিসার হন, তাঁর মৃত্যু হলে ছেলেও পুলিশ হতে পারত। আমার বাবা সেই কোটা সিস্টেমে চাকরিতে চলে গেলেন। জীবনের মস্ত বড় মোড়।

আনিসুল হক:

 মানে আপনার দাদাও পুলিশ?

রফিকুন নবী: হ্যাঁ, আমার দাদাও পুলিশ। আমার বাড়ির নামই ‘দারোগা বাড়ি’। সবাই এসপি হয়ে, পরে বড় বড় অফিসার হয়ে রিটায়ার করল। কিন্তু ‘দারোগা বাড়ি’র নাম কখনো যায়নি। যা-ই হোক, এ রকম অবস্থার মধ্যে উনি আবার ছবি আঁকতেন। উনি সুন্দর ছবি আঁকতেন।

 আমার লেখাপড়া শুরু যখন হলো, উনি ফতুল্লায় থাকতেন, সেখানে একটা ছোট প্রাইমারি স্কুল ছিল, সেখানে যাতায়াত করি। তখন উনিই স্লেট-পেনসিল কিনে দিলেন আর দিলেন আদর্শলিপির একটা বই। স্লেট-পেনসিলে উনি বসে এই যে স্বরে ‘অ’ লেখার সাথে আবার অজগরটা এঁকে দিতেন—‘দেখ, অজগর এটা, এটা সাপ।’ আর এই যে ওই আঁকাগুলো দেখতাম—স্বরে ‘অ’ তো কোনো ম্যাটারই করে না, ছবিগুলো দেখতাম। এভাবে আস্তে আস্তে তাঁর কাজের ওপরে…আমি তো আর কোনো শিল্পীর কাজ তখনো দেখিনি। ছোটবেলায়, মনে হয় সিক্স-সেভেনে পড়ার সময় থেকে জগৎটাকে চেনার একটা সুযোগ হয়েছিল। কী বলে, ‘শিল্পকলা’, যে ছবি আঁকা টাকা—এগুলো তখন থেকে জানি। যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, এই সময় থেকে জানি। তখন তো ঢাকায় রয়ে গেছি, বর্ধমান হাউসে একটা অল পাকিস্তান আর্ট এক্সিবিশন হয়েছে, আর্ট কাউন্সিলের পক্ষ থেকে। বর্তমান বাংলা একাডেমি! ওটাকে আমরা বলতাম নুরুল আমিনের বাড়ি—চিফ মিনিস্টারের বাড়ি ছিল।

 ভাষা আন্দোলনের পরে তিনি সরে গেলেন অন্যত্র। বাড়িটা তখন খালি। তখন রাইটার্স গিল্ড এগুলো সব ছোটখাটো করে করে শুরু হয়েছিল। আর বাংলা একাডেমি তখনো হয়নি। সে সময় একটা আর্ট এক্সিবিশন হলো বিশাল। তখন আমার বাবা নিয়ে গিয়েছিল, এক্সিবিশন দেখছি।

আনিসুল হক:

 তখন ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়েন?

রফিকুন নবী: ক্লাস ফাইভে পড়ি। দেখে তো তাজ্জব—‘এটা, এই ছবি! আসলে এগুলো কীভাবে আঁকল? কেমন করে আঁকল? এত বড় বড় ছবি হয়!’ কিন্তু ওইটা একটা বড় ঘটনা। তো এগুলো-এগুলো...যে সবাই বলে ইন্সপিরেশনস ইত্যাদি কথা বলে না?

আনিসুল হক:

নিশ্চয়ই।

রফিকুন নবী: এক একটা ছোট ছোট ব্যাপার...যেগুলো অজান্তে...আমি মনে করি, আমি যে ওগুলো দেখে সেদিন প্রতিজ্ঞা করে ফেলব—‘আমি আর্টিস্ট হব’—এমন তো আর হয় নাই। দেখলাম, ভালো লাগল। বাড়িতে গিয়ে আবার সেগুলো আঁকার চেষ্টা। ক্যাটালগও বেরিয়েছিল। আর সেই ক্যাটালগ ছিল আমার কাছে। কিছুদিন পরে, ইদানীং আর দেখতে পাই না। সেইটা ছিল একটা মাইল পোস্ট।

 বাবার এই স্লেটে লেখা, আঁকা দেখানো—এটা একটা মাইল পোস্ট। এগুলো থেকে থেকে, আস্তে আস্তে...তারপরে স্কুল। স্কুলে স্কাউটিং করা, সেখান থেকে দেয়ালপত্রিকার দায়িত্ব। তারপর পাড়ায় দেয়ালপত্রিকা বের হতো, সেটার দায়িত্ব।

আনিসুল হক:

পুরোটা হাতে লেখা?

রফিকুন নবী: হ্যাঁ, এ সুযোগে এতে নিজের কিছু কিছু ছড়া, কিছু গদ্য ঢুকিয়ে দিতাম। আমি তো সম্পাদক—আমার তো অনেক পাওয়ার!

আনিসুল হক:

 স্কুলে শিক্ষকদের মধ্যে কেউ ছিলেন?

 রফিকুন নবী: স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে মজা হলো, আমাদের ড্রয়িং ক্লাস নিতেন মৌলভি স্যার। উনি আরবি পড়াতেন। উর্দু। তারপরে ড্রয়িং ক্লাসটা নিতেন। নিজে বোর্ডে এঁকে দিতেন—‘বলতেন, এটা আঁকো।’ তিনি কিন্তু সব সময় বলতেন...ছোটখাটো মানুষ, মৌলভি স্যার হলেই যেটা মানে চোখে ভাসে, সে রকমই আরকি। একটু দাঁড়ি, খুব যে বয়স, তা-ও না।

আনিসুল হক:

উৎসাহ দিতেন?

রফিকুন নবী: উৎসাহ দিতেন। বলতেন, ‘তুই কী করিস? আর্ট কলেজে ভর্তি হবি?’ তো, তখন আর্ট কলেজ...এগুলো নিয়ে জানিও না, বুঝিও না। এসব নানান অভিজ্ঞতা, একটা মিশ্র ঘটনা আছে আরকি। আমার মনে হয়, এগুলো এক একটা হয়তো...পরে দেখা গেল আমার ইচ্ছার চেয়েও বাবার ইচ্ছা বেশি। বাবা বললেন, ‘তুই ম্যাট্রিকটা খালি ক্রস কর, তারপর তোকে আর্ট কলেজে ভর্তি করে দেব।’ আমি তো মনে মনে খুশি।

আনিসুল হক:

বাবার অপূর্ণ স্বাদ আপনাকে দিয়ে পূর্ণ করানোর একটা চেষ্টা। এটা আমাদের সব মা-বাবারই থাকে। নিজে যেটা করতে পানি নাই…

 রফিকুন নবী: সত্যি তা-ই। কারণ, উনি এরপরও চোখে চোখে রাখতেন, আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে। তখন তো আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়া মানে চতুর্দিকে আত্মীয়স্বজনের তাকিয়ে থাকা...যে ছেলেটাকে এই দিকে দিল...। কারণ, আমাদের বন্ধুবান্ধব সবাই কেউ নটর ডেমে চলে গেল, কেউ ঢাকা কলেজে চলে গেল, কেউ জগন্নাথে চলে গেল। আমারও সেই রকমই হওয়ার কথা। সবাই তা-ই জানে। ওগুলো বাদ দিয়ে এমন একটা লাইনে গেলাম, যেটা মানে, কী বলব, আনএক্সপেক্টেড অন্য মানুষের কাছে।

আনিসুল হক:

 হ্যাঁ, ঠিক প্রথাগত নয়। অগতানুগতিক।

রফিকুন নবী: হ্যাঁ, তো আমরা শুরু করে দিলাম। বাবা চোখে চোখে রাখতেন, মানে হলো এই যে চারদিকে মানুষের একটা চোখ আছে তো, নজরে রাখে।

আনিসুল হক:

 যেন ছেলেটা ডিরেইলড না হয়ে যায়।

 রফিকুন নবী: ডিরেল লাইনেই দিয়েছে—এটাই মানুষের ভাবনা। এটা কিছু হলো? না আছে চাকরি, না আছে ভূত ভবিষ্যৎ!

আনিসুল হক:

হ্যাঁ স্যার। আমাদের ছোটবেলায়, আব্বা পিটিআইয়ের সুপারিনটেনডেন্ট। ওখানে একটা ম্যাগাজিনে বের হলো, তাতে লেখা, আর্টিস্ট মানে হচ্ছে—একটা নোংরা লম্বা পাঞ্জাবি থাকবে, পায়জামা থাকবে, হয়তো চুল পেকে যাওয়া বৃদ্ধ, এক জোড়া চপ্পল থাকবে, একটা ঝোলা থাকবে, মানে, খুবই এলোমেলো জীবন থাকবে। এ জন্য আমি যখন ছোটবেলায় ছবি আঁকতাম, আমার আব্বা যদিও উৎসাহ দিতেন, কিন্তু আম্মা খুবই বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতেন, ‘তুমি যদি এটা করো, তাইলে এ রকম হবা।’

রফিকুন নবী: ঠিকই। এই ভাবনাটা কিন্তু আমারও ছিল। এটা কিন্তু খুব অবাক করা ঘটনা না। তখন এটাই প্রচলিত ছিল। আমিও ভাবতাম। আমার একটা ধারণা ছিল যে আর্টিস্ট হতে গেলে এ রকম পাঞ্জাবি পরবে, তারপর রিং ফ্রেমের চশমা থাকবে, ঢুলু ঢুলু চোখ, যেদিকে তাকিয়েই থাকবে তো থাকবেই...অদ্ভুত ধরনের মানুষ। তারপর একটু ময়লাটয়লা থাকবে, চুল উষ্কখুষ্ক। কিন্তু আর্টিস্ট যে হেভি স্মার্ট এবং সেয়ানা—এইটা কিন্তু চারুকলায়, আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে...সবাই স্মার্ট।

আনিসুল হক:

শিক্ষক তো সব আমাদের মহর্ষিদের পেলেন।

রফিকুন নবী: একদম। আমার ওইটা একটা ভাগ্য—শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে, একদম মুস্তাফা মনোয়ার পর্যন্ত, সবচাইতে জুনিয়র যিনি...সবাইকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। তো মানে, সফিউদ্দিন আহমেদ, কামরুল হাসান, আমিনুল ইসলাম, মোহাম্মদ কিবরিয়া—সবাই। এইটা একটা বড় পাওয়া আমার জীবনে। যা-ই হোক...আর্ট কলেজের জীবনের আগের ঘটনায় ছিলাম বোধ হয়।

আনিসুল হক:

 জ্বি।

রফিকুন নবী: সেটা হলো ওই যে স্কুলে দেয়ালপত্রিকা, সেটাতে দুইটা দিক আমার ভালো লাগত। এক হলো লেখালেখি সংক্রান্ত ব্যাপার। বড় বড় লেখকও কিন্তু লিখেছে ওই দেয়ালপত্রিকায়, আমাদের দেয়ালপত্রিকায়—বিশেষ করে পাড়ারটা। আমি যে পাড়ায় থাকতাম, সেই পাড়া একেবারে মানে...

প্রকৃতির মাঝে শিল্পী রফিকুন নবী
ফাইল ছবি: প্রথম আলো
আনিসুল হক:

তখনকার কোন পাড়াটা?

 রফিকুন নবী: নারিন্দাপাড়ায়। নামীদামি মানুষদের বসবাস। ওখানে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া থাকতেন। ওখানেই আনোয়ার হোসেন মঞ্জুদের বাড়ি। নাসির উদ্দীন সাহেব, নূরজাহান বেগম (নাসিরউদ্দিনের মেয়ে নূরজাহান), ‘সওগাত’ এবং ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক—তাঁদের বাড়ি। সেখানে ‘দাদাভাই’ (রোকনুজ্জামান খান), ওনাদের জামাতা—তিনিও থাকতেন এখানে। তারপর আল-মুতী শরফুদ্দীন—তাঁদের বাড়ি জাস্ট আমার বাড়ির অ্যাডজাসেন্ট। এ রকম পুরো সবাই। একটা বিশাল, খুব বনেদিপাড়া। তাঁদের সান্নিধ্যে ছিলাম। ওঠা-বসা।

আনিসুল হক:

তাঁদের কাছ থেকে লেখা আনতে পারতেন।

 রফিকুন নবী: তাঁরা সব উপদেষ্টা ওই দেয়ালপত্রিকার। পত্রিকার নাম ‘অভিযাত্রিক’। অনেক ক্ষেত্রে ইলাস্ট্রেশন করা, তারপর একটু গ্রাফিক ডিজাইনের দিকে সাজানো এটাকে। তারপর পত্রিকার ডিজাইনিং—এই সবকিছুর দায়িত্ব পাওয়ায়, নিজে তৈরি হওয়ার একটা ঘটনা ভেতরে-ভেতরে চলছিল বাল্যকালে। সেটা আর্ট কলেজে যাওয়ার পরে দেখি যে এটা বিশাল জগৎ। কিন্তু ওই জগতে যে ঢুকলাম, ওই পুরোনো জগৎটা কিন্তু আমাকে হেল্প করেছে।

আনিসুল হক:

নিশ্চয়ই।

রফিকুন নবী: সেটা, সব সময় বলি, একটা মজার ভেতর দিয়ে আসা।

আনিসুল হক:

স্যার, আর্ট কলেজে আপনার রেজাল্ট ভালো ছিল?

 রফিকুন নবী: এটা একটা মজার…আমি তো ভর্তি পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে ভর্তি হয়েছি। তারপর ফার্স্ট ইয়ারে, ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম, ফার্স্ট হলাম। হওয়ার পরে—ফার্স্ট ডিভিশনে ফার্স্ট ইত্যাদি, সব খুব ভালো ছাত্র।

 সাথে সাথে আমরা ওই যে, কী, ফোর্ড ফাউন্ডেশন নাকি এশিয়া ফাউন্ডেশন—কিসের একটা বৃত্তি পেয়ে গেলাম। বেস্ট ছাত্রদের জন্য দেয়। তার পরের বছর, এই একটা ছোঁক ছোঁক ব্যাপার আসল—একটু ইনকাম-ইনকাম, যে একটু যদি ইনকাম কিছু করা যায়, মন্দ কী। ইলাস্ট্রেশন—এই বাংলাবাজার বইপাড়ায়। সেগুলা করতে করতে ওর মধ্যে একটা ইনভলভমেন্ট এসে গেল। তখন সেকেন্ড ইয়ার থেকে থার্ড ইয়ারে ওঠার সময়, একধাপ নেমে গেলাম।

আনিসুল হক:

সেকেন্ড হয়ে গেলেন?

 রফিকুন নবী: সেকেন্ড হয়ে গেলাম। তা-ও আমি কাজ ছাড়ি নাই। আমি এরপরে আবার যুক্ত হলাম। থার্ড ইয়ারে ওঠার পরে কার্টুন আঁকা ধরলাম।

আনিসুল হক:

সংবাদপত্রে কার্টুন আঁকা শুরু করলেন?

 রফিকুন নবী: সংবাদপত্র...সংবাদপত্র তো ছাপে না, মানে...

আনিসুল হক:

অত টেকনোলজি ছিল না হয়তো।

 রফিকুন নবী: কিন্তু এই যে কিসের মিছিল, আন্দোলনের মিছিলে ধরা খেলাম। ওগুলোতে আমি জীবনে কখনো কিন্তু কোনো মিছিলে যাইনি—যে স্লোগান দিয়ে মিছিলে যাওয়া ইত্যাদি যাইনি। কিন্তু ওই মিছিলগুলাকে সাজাবার... প্রায় শ খানেক—১৫০টা কার্টুন এঁকে দিতাম। ওই যে ফুল হিসেবে চাটাইতে লাগিয়ে, তারপর এটা সবার হাতে হাতে থাকত। এইটা করা হতো। তো, এইগুলা—তো দেশাত্মবোধ সাংঘাতিক গ্রো করছে, সেকেন্ড ইয়ার-থার্ড ইয়ারে পড়তে পড়তে।

আনিসুল হক:

 আপনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন নাই?

রফিকুন নবী: কোনো পার্টিতে আমি কখনোই যোগ দিই নাই। যখন যারই প্রয়োজন হয়েছে—কাজ করে দিয়েছি। যে, ‘ঠিক আছে, একটা প্রচ্ছদ করে দেন। আমাদের এ রকম একটা জিনিস বেরোচ্ছে।’ ছাত্র ইউনিয়ন বেশি লাভবান হয়েছে। ওদের ছেলেরা রুচিমান ছিল। কারা ছিল? আমাদের মতিউর রহমানরা ছিল, মাহ্ফুজ আনাম, আবুল হাসনাত—এরা হলো জুনিয়র গ্রুপ। এদের সিনিয়র গ্রুপ ছিল একটা। সব মিলিয়ে ওদের সঙ্গে যুক্ততাটা ছিল। ভালো লাগত। ওরা লেখাপড়ায় ভালো। সবাই—লেখাপড়া, সবকিছু মিলিয়ে বলতে পারে ভালো।

আনিসুল হক:

  ওই জন্য কাজ বেশি করেছেন ওদের সঙ্গে।

 রফিকুন নবী: হ্যাঁ। তারপরে অ্যাভয়েডিংয়ের ঘটনাও থাকত যে ও তো ছাত্র ইউনিয়নের কাজগুলো করে দিল। তো ছাত্রলীগ, ওরা সব সময় পাতি লাইনে রেখে দিল, যে ওদের কাছে যাওয়া যাবে না। পরে তো অন্য রকম হলো। সবাই আপন। সবাই পরস্পরের সাথে যুক্ত। কিন্তু আবার রেজাল্ট খারাপ হলো—এসব ইনভলভমেন্টের কারণে। থার্ড ইয়ারে থার্ড হয়ে গেলাম।

আনিসুল হক:

ফোর্থ ইয়ারে, ফাইনাল ইয়ারে কী হলেন?

 রফিকুন নবী: ফোর্থ ইয়ারে গিয়ে আমার বাবা বলল, ‘কিরে, তোর হলোটা কী? সবাই ওপরে যায়, তুই তো নিচে নামছিস! নামটাম ডুবাস না। বহু...ইয়ে...করে তোকে তো দিলাম আর্ট কলেজে, ভালো কিছু কর।’

 তখন স্যাররাও কিন্তু খুব কনসার্ন যে এটা কী হলো? ও এ রকম তলায় কেন? তারাও একটা টাইট দেওয়ার চেষ্টায়। ফোর্থ ইয়ারে সিরিয়াস হলাম, ফাইনাল ইয়ারে সিরিয়াস হলাম। এবং তারপরে আবার রেজাল্ট ভালো হলো। ফোর্থ ইয়ারে আবার সেকেন্ড পজিশনে চলে আসলাম। ফাইনাল ইয়ারে উঠলাম সেকেন্ড হয়ে। ফাইনাল ইয়ারে গিয়ে আবার ফার্স্ট ক্লাস।

আনিসুল হক:

ফার্স্ট!

 রফিকুন নবী: আমাদের ক্লাসে একজনই ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, অতএব ওটা ফার্স্ট লাস্ট সবই।

আনিসুল হক:

ফার্স্ট ক্লাস একজনই পেলেন। আর আপনার সাথে যাঁরা ফার্স্ট-সেকেন্ড হতেন, তাঁরা কারা ছিলেন?

রফিকুন নবী: তারা টেলিভিশনের আনোয়ার হোসেন, চিফ ডিজাইনার ছিল। তারপর ডিরেক্টর। তারপর প্রফুল্ল ছিল, প্রফুল্ল রায়, আমাদের ক্লাসের রঞ্জিত নিয়োগী—সেই বিখ্যাত নেতা রবি নিয়োগীর ছেলে। ও খুব সুন্দর, ভালো কাজ করত। এরা ছিল আমাদের। আমরা সব ছিলাম।

আনিসুল হক:

আপনি জয়নুল আবেদিন স্যারের ক্লাস তো পেয়েছেন?

 রফিকুন নবী: হ্যাঁ। উনি তো রেগুলার ওইভাবে ক্লাস নিতে পারতেন না। সব সময় ব্যস্ত থাকতেন।

তো উনি যেটা করতেন, হঠাৎ করে ক্লাসে চলে আসতেন। অধ্যক্ষ তো চলে আসতেন। আর মাঝে মাঝে, যখন কোনো টিচার হয়তো ছুটিতে আছে, এক সপ্তাহ আসবে না—তখন ওই ক্লাসগুলো উনি নিতেন।

আনিসুল হক:

 এঁদের সঙ্গে কোনো স্মৃতি আছে? স্পেশাল, ধরেন, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান বা অন্য কেউ?

রফিকুন নবী: হ্যাঁ। যেমন কামরুল হাসানেরটা তো খুব বড় একটা স্মৃতি আমার। আমি তখনো কোনো আর্টিস্টকে চিনতাম না। চিনতাম শুধু কামরুল হাসানকে।

 প্রথমে নামে চিনতাম। কারণ, ক্লাস এইটে একটা বই পাঠ্য হলো আমাদের হঠাৎ করে। ওটা র‍্যাপিড রিডারও না, সরকার থেকে একটা বই, উপহার হিসেবে না অনুদান হিসেবে স্কুলগুলোকে দিল। সেটা ছাত্রদের মধ্যে, ক্লাস এইটে বিলি-বণ্টন করেছে।

 প্রথম অফসেটে ছাপানো একটা বই, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ইলাস্ট্রেশন দিয়ে। ওই ইলাস্ট্রেশনের নিচে কামরুল লেখা থাকত। স্যাররা এই যে ক্লাসে বইটা বিলি করলেন—এই যে, ‘এই ছবিগুলো হলো কামরুল হাসানের। উনি কিন্তু খুব বড় আর্টিস্ট।’ ওইভাবে তাঁর নামটা আমার জানা ছিল।

 তো কচিকাঁচার মেলা আছে আমাদের দাদাভাইয়ের (রোকনুজ্জামান খান)। উনি তো আমার পড়শি। আমি কচিকাঁচাও করি নাই কখনো। কিন্তু দাদাভাই বলল, ‘তুমি ছবি দাও।’ ক্লাস এইটে তখন। বললেন,‘ছবি দাও। আমাদের আর্ট কমপিটিশন হবে।’ পরে, দিলাম। সেটা তো পুরস্কার পেল। পুরস্কার গ্রহণের একটা দিন ঠিক হলো। পুরস্কার দেওয়া হবে। সেখানে শুনলাম শিল্পী কামরুল হাসান আসবেন। আমি তো উত্তেজিত! ধারণা তো আমার ওইটা রয়ে গেছে ভেতরে, ওইটা নিয়ে বসে আছি—একটা চশমা থাকবে, একটা পাঞ্জাবি, হাড় জিরজির লোক হবে—এ রকম। তো এই হলের মধ্যে বসে আছি। ইত্তেফাকের একটাই ঘর, কচিকাঁচার ওদের ঘর। সেখানে বসে, যে দাদাভাই খুব ছোটাছুটি করছে—‘প্রধান অতিথি আসবে এখনই।’ তারপর ছুটে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে একজনকে নিয়ে আসল একদম হাড়জিরজিরে। সেই লোক শিল্পী, প্রধান অতিথি, এসেই উনি ডায়াসে বসিয়ে দিলেন। আমি তো দেখে অবাক হয়ে তাকিয়েছি!

 তারও পাঁচ মিনিট পরে আসলেন এই গাট্টাগোট্টা, নাক বোঁচা, এ রকম। সবাই দাঁড়িয়ে গেল। তখন আমিও দাঁড়ালাম। আগেও দাঁড়ালাম, এখনো দাঁড়ালাম। তখন দেখি, ওই ডায়াসে গিয়ে বসাল, ওই ওনার পাশে। তখন দাদাভাই উঠে বলল, ‘এই যে শোনো, আমাদের আজকের প্রধান অতিথি কামরুল ভাই, কামরুল হাসান, আমাদের শিল্পী ইত্যাদি।’

 আমি অবাক হলাম যে এ রকম একটা স্মার্ট লোক!

আনিসুল হক:

তাহলে আগে যিনি এসেছিলেন, উনি কে?

 রফিকুন নবী: উনি সরদার  জয়েন উদ্দিন, হাড়জিরজিরে। কিন্তু ওইটা আমার ধারণার সাথে মিলে গিয়েছিল।

 ওনার পায়জামা, পাঞ্জাবি ছিল। আমার যে ধারণার সাথে মিলে গিয়েছিল। কামরুল হাসান, সেই ধারণাটা একদম বদলে দিলেন। তারপরে তো আর্ট কলেজে যখন ভর্তি হলাম, তখন জয়নুল আবেদিনকে দেখি মহা স্মার্ট মানুষ। তারপরে অন্যরা, তখন আমিনুল ইসলাম বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন। সেই আর্টিস্ট জ্যাকেট গায়ে দিয়ে আসেন, জিনসের প্যান্ট ওই সময়।

আনিসুল হক:

ওই সময়ে?

 রফিকুন নবী: তখন এলভিস প্রিসলিদের আমল চলছে। ও রকম সব খুব স্মার্ট। তো কিবরিয়া স্যারের মধ্যে কিছুটা ওই মিল ছিল।

আনিসুল হক:

আর্টিস্ট আর্টিস্ট বলতে আমরা যে ছবি ছোটবেলায়

 রফিকুন নবী: কথা কম বলতেন। যা-ই হোক, এসব এক একটা অভিজ্ঞতা আরকি।

শিল্পী রফিকুন নবী বেশি পরিচিত রনবী নামে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো
আনিসুল হক:

আপনি স্যার, বইয়ের প্রচ্ছদ করতে শুরু করলেন মোটামুটি। কবে থেকে?

 রফিকুন নবী: ওই তো সেকেন্ড ইয়ারে উঠেই বই।

আনিসুল হক:

 ওই সময় তো ব্লক করে প্রচ্ছদ করা হতো!

 রফিকুন নবী: ব্লক। তখন ব্লক কোম্পানি ছিল অনেকগুলো। ওদের দুই-তিনটা ধরন ছিল। একটা ছিল, ওই যে পাতে। মানে, মেটালের সাথে অ্যাসিড দিয়ে যেভাবে করে, এইটা-ওটা ট্রান্সফার করত ক্যামেরা দিয়ে, এইটি করে। আবার, এইটা একটা প্রসেস ছিল। আবার ডাইরেক্ট ড্রয়িং বসিয়ে ভাগ করে করে করত। এটা ছিল কাঠের ওপর। ওটা আবার পিন করে বসাত, আঠা দিয়েও বসাত। আর আরেকটা ছিল কাঠের। কাঠ কেটে করত। আমরা যেভাবে উডকাট করি—এইটাই। এবং সেটাতে হেডিংগুলো বড় হতো। এত বড় বড় হেডিং, যেগুলো ছিল আট কলাম, আট কলাম, দুই ইঞ্চি হয়তো একেকটা আরকি। তো সেইগুলা ওই ওইভাবে কাঠ দিয়ে কেটে অক্ষরগুলো বানাত, বানিয়ে তারপর বসে, তারপর ছাপ। এটা বেশির ভাগ।

আনিসুল হক:

 ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৬৩ সালে পাস করে বের হলেন, না ’৬৪ সালে?

 রফিকুন নবী: ’৬৪ সালে।

আনিসুল হক:

 ওই সময়ের ছবি—’৬৭, ’৬৮ সালের ছবি তো আপনার এখানে কালেকশনে আছে এখন, নাকি?

 রফিকুন নবী: তখন তো আমরা ওয়াটার কালার করতাম বেশি। আবেদিন স্যার থেকে শুরু করে সবাই।

আনিসুল হক:

 তখনকার আপনার জলরঙের মধ্যে কি জয়নুল আবেদিন স্যারের একটু প্রেরণা ছিল?

রফিকুন নবী: এটা আমি বলি না—সবারই তখন তো জলরং বললেই আবেদিন স্যারের কাজের কথা মনে হয়। এখনো হয়। এটা এখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। তারপরে সেখানে একটু, অন্য টিচাররা যাঁরা ছিলেন, আবেদিন স্যারেরই ছাত্র—আমাদের টিচার হয়েছেন—তাঁদের মধ্যেও সেটা ছিল। আবার এখানে মুস্তাফা মনোয়ার স্যার যখন আসলেন কলকাতা থেকে পাস করে, তখন উনি ওয়াটার কালারের ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন, সেইটা আবার আরেক আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল। একটু একটু বৈপরীত্য ছিল আবেদিন স্যার এবং তাঁর স্টাইলের মধ্যে—ইউজ অব কালারস, সব মিলে।

আনিসুল হক:

 তারপর আপনি টোকাই আঁকা শুরু করলেন কি বাংলাদেশ হয়ে যাওয়ার পরে?

 রফিকুন নবী: টোকাই তো এই যে বিচিত্রায়।

আনিসুল হক:

তার আগে কি আপনি সংবাদপত্রে এঁকেছেন?

রফিকুন নবী: হ্যাঁ, তার আগে এঁকেছি। হঠাৎ হঠাৎ ছোট।

আনিসুল হক:

 কোন পত্রিকায় আঁকতেন?

রফিকুন নবী: ওই যে, সংবাদে ছিল। তারপরে এগুলো, সিঙ্গেলই ঠিক বলা যাবে না। কী বলে, কার্টুন যে আলাদা আলাদা একটা জিনিস—ওইভাবে না। ইলাস্ট্রেশন হিসেবে ব্যবহার হতো। সেইটা আবার শুরু হয়েছিল, এই  পূর্বদেশ। পূর্বদেশ তো তখন সাপ্তাহিক। এবং সেটার সম্পাদক ছিলেন আমাদের কাজী ইদ্রিস সাহেব।

আনিসুল হক:

টোকাই কত সালে প্রথম বের হলো?

রফিকুন নবী: ১৯৭৭ সালে।

আনিসুল হক:

তখন আপনি...?

রফিকুন নবী: আমি তখন বিদেশ থেকে ফিরলাম। রোজগার নাই। এসে দেখি, যে আমার চাকরিটাও নাই।

আনিসুল হক:

ছাপচিত্রের ওপর পড়াশোনা করতে আপনি কোথায় গেলেন? গ্রিসে?

 রফিকুন নবী: গ্রিসে।

আনিসুল হক:

কত বছর ছিলেন, স্যার?

রফিকুন নবী: তিন বছর।

 তিন বছর পর। তারপর তো দেশে নানা রকম ঘটনা ঘটল। এই যে ’৭৫-এর ঘটনা। তারপর আবেদিন স্যার মারা গেলেন ১৯৭৬ সালে। একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে, যে কী হচ্ছে? বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব—সব ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে নাকি দেশে? কী হচ্ছে? চলে আসলাম, ‘পরে আবার যাব, ঠিক আছে।’ চলে এসে আর তো গেলাম না।

আনিসুল হক:

ও, ওখানকার পড়া শেষ করেন নাই?

রফিকুন নবী: পড়া সব শেষ করে। ওখানে পড়া মানে, পোস্টগ্র্যাজুয়েট। এ বৃত্তি তো পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্কলারশিপ। সেটা হলো ওদের প্রফেসরের আন্ডারে। গবেষণার মতো।

আনিসুল হক:

ওখানে কি কাঠখোদাই আপনার বিশেষ আগ্রহের বিষয় ছিল?

 রফিকুন নবী: আমি নিয়েছিলাম কাঠখোদাই। কারণ, চয়েসটা আমার ছিল। বৃত্তি তো দিয়ে দিয়েছে। আমি এখান থেকে চলে গেছি, ফাইন আর্টের যেকোনো সাবজেক্ট নিতে পারি। ওখানে যাওয়ার পরে ওই ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখলাম যে পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট খুব রিচ, ভালো। কিন্তু এই প্রিন্ট মেকিং ডিপার্টমেন্টে, ছাপচিত্র বিভাগে গিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম—যেই প্রফেসর থেকে শুরু করে, ইভেন ছাত্ররাও একটু ওপরের ক্লাসে, যে ছাত্ররা বড় বড় উডকাট করছে—যেটা আমি তো জীবনে দেখিনি। মানে বিশাল একটা ৪ ফিট বাই ৮ ফিট বোর্ড আছে না? এ রকম সব সাইজে উডকাট। অবাক বিষয় হলো কাগজই-বা পেল কোথায়? আর এটা কাটলই-বা কী করে? ছাপলই-বা কেমন করে?

আনিসুল হক:

আপনার প্রথম একক প্রদর্শনী কোথায়?

 রফিকুন নবী: এথেন্সে।

 ওখানে এথেন্সে প্রথম একক প্রদর্শনী! বেশ, বিক্রিবাটা খুব ভালো লাগল।

আনিসুল হক:

 ওখানে কি কাঠখোদাই ছিল?

আনিসুল হক

রফিকুন নবী: কাঠখোদাই ছিল, পেইন্টিং ছিল, জলরং ছিল।

আনিসুল হক:

মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেন!

 রফিকুন নবী: অত না। কিন্তু ওখানে বৈদেশিক মুদ্রা মোটামুটি—‘ড্রাকমা’ বলত। আমি তো স্কলারশিপ পেতাম ১১ হাজার ড্রাগমা। এটা দিয়ে বাড়িভাড়া দিতাম। আমি তো হোস্টেলে থাকি না। কারণ, হোস্টেলের যে ঘরটা, কাজ করার সুযোগ খুব কম, মানে অনেক ছোট স্পেস। পরে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলাম। তাই ১১ হাজারে মোটামুটি বাড়িভাড়া, একটু একটু রংতুলি, এটা-সেটা কেনার মতো...। আর খাওয়াদাওয়া করতে করতে ১১ হাজার শেষ। কোনোই সঞ্চয় হতো না।

 কিন্তু যখন ওখানে আমার প্রফেসর...ওনাকে একদিন আমার বই দেখিয়েছিলাম, ইলাস্ট্রেশন। উনি ইলাস্ট্রেশন করতেন। আমাদের এখানে ইলাস্ট্রেশন করলেই তো আর্টিস্টদের বকাবাজি করা হতো। ওখানে গিয়ে দেখি, ইলাস্ট্রেশনে ওনার ইন্টারন্যাশনাল ফেইম আছে, তো ওনারটা দেখে, আমি বললাম, আমি তো আঁকি, আঁকতাম দেশে।

আনিসুল হক:

বই রাখলেন?

 রফিকুন নবী: হ্যাঁ। এমনি লাইনের কাজ। কয়েকটা বই দেখালাম। উনি কেন যেন হঠাৎ করে খুব প্রশংসা করলেন, ‘আরে, এত সাংঘাতিক! তোমার একটা ‘র’নেস...’ কী কী সব বলে টলে, বলে যে, ‘তোমার বাসায় আমি একজনকে নিয়ে যাব।’ উনি পরের দিনই তাঁর পাবলিশারকে নিয়ে এলেন। এবং সেই পাবলিশারের একটা গ্যালারি আছে—সেখানে উনি কালেক্টর, বিগ কালেক্টর পেইন্টিংয়ের... আমার বাড়িতে আমি তো, ওই যে স্টুডেন্টস কট, একটা আরেকটা কাপড়ের চেয়ার...এই আমার সম্বল। সেখানে যা-ই হোক, এই ভদ্রলোক তো চেয়ারে বসতে পারলেন না। খাটে বসলেন। তারপর, ‘বই কোথায়? বইগুলা দেখাও।’ বই দেখে তিনি বললেন, ‘তুমি আমার একটা বইয়ের সিরিজ করো।’ সেই সিরিজের আমি চারটা বই পর্যন্ত করতে পেরেছিলাম। এক একটা বইতে প্রায় আমি তুলনামূলক এটা দিচ্ছি যে আমার মাসিক বৃত্তি ছিল ১১ হাজার ড্রাগমা। আর এক একটা ১৬ পৃষ্ঠার বইতে পেলাম প্রায় ৯০ হাজার ড্রাকমা।

আনিসুল হক:

 প্রতিটা বইয়ে ৯০ হাজার...ড্রাকমা পেলেন?

 রফিকুন নবী: হ্যাঁ। ১৬ পৃষ্ঠায়…আমি আমার অন্য বন্ধুদের যখন দেখালাম, বলল, ‘কত পাইলা?’ ওরাও তো করে, একটু চুপচাপ। তো বললাম, ‘৯০ দিল।’ ‘আরে ঠকাই দিছে তোমাকে। এটা তো তোমার মানে দেড় লাখ, দুই লাখ হওয়ার কথা। আমরা করলে তো...’ এটা তো ভাই, আমি জানি না। আমি তো এতেই খুশি। ওই চারটা বই করেছিলাম। ওই পয়সাগুলো যখনই পেতাম, তখনই আমি টিকিট কাটতাম—কখনো ইজিপ্ট, কখনো রোম, কখনো ফ্লোরেন্স। এভাবে মানে, পুরো ইউরোপের যেখানে যেখানে…

আনিসুল হক:

 প্যারিস যান নাই?

রফিকুন নবী: এথেন্স থেকে প্যারিস পর্যন্ত বাসে গিয়েছি। এই রোমে গেলাম, রোমে নেমে গেলাম। ওইখানে চার দিন থাকলাম। তারপর আবার পরবর্তী বাসটা এসে উঠিয়ে নিল। এটা প্যাকেজ। এভাবে ওখান থেকে ফ্লোরেন্স, ফ্লোরেন্স থেকে ভেনিস, ভেনিস থেকে মিলান। এ রকম করতে করতে তুরিন দিয়ে জেনেভা হয়ে প্যারিস। এটা একটা বিগ এক্সপেরিয়েন্স আমার।

আনিসুল হক:

গ্যালারিতে ছবি দেখে দেখে...

রফিকুন নবী: ছবি দেখে দেখে।

আনিসুল হক:

বিশ্বের শিল্পীদের মধ্যে আপনার প্রিয় শিল্পী?

 রফিকুন নবী: সেই—এইটা বলা বড় কঠিন: প্রিয় শিল্পী বের করা। একেকজনের একেক রকম কাজ, একেক ধরনের কাজ। একেকজনের একেক বোধ, একেকজনের একেক কৌশল, একেকজনের একেক রীতি। একটা বিশাল জগৎ। এর মধ্যে কেউ না ঢুকলে ঠিক, মানে ঢোকা মানে কি স্টাডির চোখ নিয়ে ঢুকতে হবে—তাহলে এই অবাক হওয়ার কাণ্ডটা ঘটবে।

‘টোকাই’ চরিত্র রনবীর অনন্য এক সৃষ্টি
ফাইল ছবি: প্রথম আলো
আনিসুল হক:

কামরুল হাসানের ওপরে পিকাসোর খুব প্রভাব…

রফিকুন নবী: আমি ‘প্রভাব’ বলব না; আমি বলি যে, কামরুল হাসান যদি ইউরোপে জন্মাতেন, তাহলে পিকাসোর খবর ছিল।

আনিসুল হক:

যদিও আমার বাংলাদেশের লোকশিল্পের...

 রফিকুন নবী: একদম! কিন্তু এইটাকে ভেঙে—মানে, এই লোকশিল্পের ধরনগুলোকে ভেঙে যে এত আধুনিকের মিশ্রণ—এটা একটা অসাধারণ। আবার ওইখানে শুধু কামরুল হাসানের মধ্যে থাকলেই হবে না: জয়নুল আবেদিন—তাঁর যে ’৫০ দশকের ফোক নিয়ে কাজ, প্রথম দিকে একটু যামিনী রায়..., তার পর থেকে সরে একেবারে নিজের একটা ধরন তৈরি হলো। দুজন পাশাপাশি কাজ করছেন: একদিকে আবেদিন স্যার, অন্যদিকে কামরুল হাসান—দুজনই ফোক থেকে নিয়ে কাজ করছেন, কিন্তু দুজনের দুই রকম পথ।

আনিসুল হক:

সেদিকে স্যার, আপনার ছবিটা খুব আপনার মতো লাগে আমার কাছে।

 যে মানুষ...

রফিকুন নবী: আমি তো...

আনিসুল হক:

আপনি তো ইলাস্ট্রেশন প্ল্যাটফর্মের মানুষ। যদিও ছাপচিত্রের মধ্যে আমার মনে হয় যে শৈশবের যেসব গল্প করছিলেন—বড় মাছ, চলনবিল, লৌহজংয়ে অনেক পানি; মাছ ধরা; পানি।

রফিকুন নবী: বন্যার সময় একদম ভরে যায়।

আনিসুল হক:

সেগুলোর ছাপ হয়তো আছে...

রফিকুন নবী: হ্যাঁ, পদ্মার কাছে থাকতাম।

আনিসুল হক:

কিন্তু এখনো যে ছবিগুলো আপনি আঁকেন—তার মধ্যে অনেক মানুষ থাকে, মানুষের মুখ থাকে। এবং আমি অবাক হই যে—নীল রঙের একটা বড় ছবি আছে প্ল্যাটফর্মে, অনেক মানুষ বসে আছে। সবগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি; সবার মুখে একটা এক্সপ্রেশনও আছে।

 কতগুলো টোকাই বা টোকাই না—কিশোর-শিশু। একটা শিশুর চোখের দৃশ্যে, যে দৃষ্টি; পৃথিবীর দিকে এমন একটা—না বিষাদ, না রাগ—কী নিয়ে যে তাকিয়ে আছে। মনে হয়, ওই শিশুর চোখের মধ্য দিয়েই সব কথা বলা হয়ে গেল: এই পৃথিবীটা ন্যায্যতাভিত্তিক নয়। এটা আমার মনে হয়েছে। আমি লিখেছি: ‘আপনাকে আমরা হয়তো চিনলাম না। এটা আরও ১০, ২০, ২৫ বছর পরে আপনার একটা আন্তর্জাতিক মূল্য হবে।’ এটা আমার মনে হয়।

রফিকুন নবী: আমি যেটা করি পেইন্টিংয়ে, সবার ভালো লাগে—এটা তো আমি চাই যে সবার ভালো লাগবে।

 একটা ট্রেন্ড আছে: অনেক শিল্পীর মধ্যে একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে—তাঁরা দারুণ ছবি আঁকছেন, তাঁদের কাছে চমৎকার সব চিত্রকর্ম আছে, কিন্তু বাইরের দুনিয়ার কাছে তা তুলে ধরছেন না। কোনো এক্সিবিশন করেন না, কাউকে দেখতেও দেন না। নিজে নিজে করে, এক্সপেরিমেন্ট করে, অনেক কিছু হচ্ছে এবং সেইটা লুকানোই থাকল—তাহলে আর হলো না।

 আমি নিজের জন্যই, শুধু নিজের আনন্দে আঁকলাম; আনন্দে রেখে দিলাম। এইটাতে ঘটনাটা পূর্ণতা পেল না। আসলে—যখন সে ছবিটা আঁকলাম, এটা কখন কাউকে দেখাব? এবং সে কী বলে? ভুলত্রুটি কোথায় ধরে? কিংবা ভালো বলল না মন্দ বলল? এইটার জন্য কিন্তু একটা আঁকুপাঁকু অবস্থা থাকে।

আনিসুল হক:

 ছবির কি স্যার ভুলত্রুটি আছে?

 রফিকুন নবী:  ভুলত্রুটি না হলে তো হবেই না। ওই ভুলত্রুটিটা শোধরাতে শোধরাতে সারা জীবন কাজ হয়, যে ‘নেক্সট টাইমে এইটা শুধরে নেব। নেক্সট টাইমে নিশ্চয়ই মাস্টারপিস হবে।’ তো ওইভাবে মানুষের কাছে ছবিগুলো আনি। আমি সব সময় বলি—রিয়েলিটি নিয়ে কাজ করি। তো সবাই বলে রিয়েলিটি; আমি অত রিয়েলিটি বলি না, কারণ রিয়েলিটি করা চাট্টিখানি কথা নয়। করে লাভই-বা কী? একদম হুবহু করে ফেললাম—আঙুর টসটসে করে ফেলল।

 কিন্তু রিয়েলিটিকে নিয়ে—এইটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, নানানভাবে উপস্থাপন করার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। অরিজিনাল মোষ ক্যানভাসে বসিয়ে দিলে সেটা কোনো মজা হলো না। কিন্তু মোষ আমি এমন একটা স্টাইলে, এমন একটা ড্রয়িংয়ের ভেতর দিয়ে রং দিয়ে আঁকলাম যে অন্য মোষের সামনে রাখলে এটাকে কেউ ‘মোষ’ বলবে না। কিন্তু আমি বলি, ‘এটা আমার মোষ।’ লোকে যখন আলাদাভাবে দেখে মোষের দিকে, তো আর কেউ মাঠঘাটে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে না। এই মোষটা তখন বলে—‘হ্যাঁ, এইটা মোষ, মোষ...রফিকুন নবীর মোষ।’ আমিও বলি—‘এটা রফিকুন নবীর মোষ।’

আনিসুল হক:

আপনার আঁকা ছাগলটাও খুব সুন্দর, স্যার।

রফিকুন নবী: ছাগল। আর ছাগলের একটা মজা হলো, ‘এটার ফর্মটা ফর্ম এবং...’

আনিসুল হক:

 পিকাসোর ছাগল আছে। মার্ক শাগলের অনেক ছাগল আছে।

 রফিকুন নবী: আমরা তো শাগালের সিগনেচার দেখেছি, আমরা ছাগলই উচ্চারণ করতাম।

 আমাদের রশিদ চৌধুরী প্রথম দিকে শুরু করেছিলেন কিন্তু শাগালকে ফলো করে, যখন স্পেনে ছিলেন তখন।

আনিসুল হক:

 স্যার ধরেন—ভ্যান গঘ, সালভাদার দালি...

রফিকুন নবী: ওই যে বললাম—একেকজন একেক রকম। অবাক করা কাণ্ড! ভ্যান গঘ—এই যে থিকনেস, রঙের...সেখান থেকে যে মানে ওই যে টেক্সচার বের করে কাজ করা। এটার মানে যারা আঁকে না, তাদের কাছে একরকম মনে হবে; কিন্তু যারা আঁকে, তাদের কাছে—মানে আমি ফিল করি। কী করে সম্ভব! এই টোনস রাখা, টোনাল ভেরিয়েশনস রাখা, বাতাস বইছে, সেই ফিলিংটা নিয়ে আসা—এইটা একটা বিষয় বাছাই। সেটাকে কম্পোজিশন, পজিশনটা—একদম প্রচলিত না।

আনিসুল হক:

আপনি স্যার, যখন ক্যানভাসের সামনে—শূন্য ক্যানভাসের সাথে দাঁড়ান, তার আগেই কি আপনি পরিকল্পনা করেন যে এবার আমি এটা আঁকব? নাকি দাঁড়ানোর পর এটা আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে যায়?

রফিকুন নবী: না—ছবি তো বদলায়। আমি ভাবলাম একরকম।

আনিসুল হক:

ক্যানভাসটা যখন শূন্য থাকে, যখন সামনে দাঁড়ান, তখন কি আপনি ভেবে আসেন—‘আমি আজকে এমন কিছু একটা আঁকব’? নাকি দাঁড়ানোর পরে হাতটা চলে গিয়ে...?

 রফিকুন নবী: না, একটা ধারণা থাকে।

 শুরু করার সময় একটা ধারণা থাকে—‘আমি এভাবে আঁকব, শুরু করব’—তারপরে ওটা বদলাতে থাকে। যেটা ভেবেছিলাম হয়তো—ওটা থাকলই না।

আনিসুল হক:

অয়েল পেইন্টিং সর্বোচ্চ কত দিন ধরে এঁকেছেন?

 রফিকুন নবী: এই যে এমনি অ্যাক্রিলিক দিয়ে যদি বিচার করি—সেটাও দেড় মাস, দুই মাস একটা ছবিতে কাজ করা।

আনিসুল হক:

কষ্টকর তো, শারীরিক পরিশ্রম।

রফিকুন নবী: শারীরিক পরিশ্রম তো বটেই—মগজের পরিশ্রম, চোখের পরিশ্রম, পিঠে...যা-ই হোক—যে কথাটা উঠল, ‘শূন্য ক্যানভাস।’

 পিকাসোর খুব ভালো একটা কথা আছে: পিকাসোকে ঠিক এই প্রশ্নটাই করেছিল, ‘শূন্য ক্যানভাসের সামনে যখন বসেন, তখন আপনি কী ভাবেন? কীভাবে ছবিটা শুরু করেন? কোথায় গিয়ে শেষ হয়?’

  ‘আরে, এতটুকু হোক, আর বিশাল হোক—ঘটনাটা একই। যখন তার সামনে বসি আঁকতে, মনে হয় মহাসমুদ্রের সামনে বসে আছি—এখন নৌকা ভাসাব। যখন তুলি ঠেকাই—নৌকা ভাসল। কখনো কখনো নিজেই দেখি একটা ডাঙায় পৌঁছে গেছি।’ পিকাসোর উক্তি আছে—অবশ্যই এটা বইপত্র থেকে পাওয়া। কোথায় যেন পড়েছিলাম—এটাই কিন্তু সব আর্টিস্টের ক্ষেত্রেই ঠিক। কেউ ক্যানভাসের ওপরে থেকে কাজ করে নিচে নামে, কেউ নিচ থেকে ওপরে, কেউ ডান থেকে বাঁ দিকে; আর কেউ সরাসরি করে সবটা লাটাপাটা করে নামে। এটা একটা মজা আছে।

আনিসুল হক:

মজা! এখন স্যার, টোকাই নিয়ে বলেন—টোকাই তো আপনাকে বেশি বিখ্যাত করল।

 রফিকুন নবী: হ্যাঁ, টোকাই। আমি নিজেকে তো তিন-চারটা ভাগে ভাগ করে ফেলেছি; অজান্তে হয়ে গেছে। অবস্থাদৃষ্টে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে। যখন পেইন্টার বা আর্টিস্ট—বা এই ছবি আঁকা বা আঁকিয়ে—তখন মানে একরকম। ওইটা যখন করি, তখন কিন্তু ওর মধ্যেই থাকি: ওই পেইন্টিংয়ের যাবতীয় যা কিছু জ্ঞান, গরিমা—সেইখানে। ওই ক্যানভাসের সামনে বসলে—ওইখানেই হয়। বা কাগজে যখন ড্রয়িং করব—তখন সেখানে থাকি। কিন্তু যখন এই কার্টুনের কাছে যাই—তখন তো পাঠকের কথা ভাবতে হয়, মানুষের কথা ভাবতে হয়: ‘অন্যদের কাকে নিয়ে করছি, কী করছি, কেন করছি, কার জন্য করছি’—অনেক কিছু ভাবতে হয়। এরপর সাবজেক্ট বাছাইয়ের একটা মজা—করতে করতে মজা পাওয়াটা হলো আসল। মজা পেতে পেতে একসময় দেখি, এটা একেবারে মজ্জায় ঢুকে গেছে; মজাটা ‘ডাবল জয়ে’ চলে গেল।

আনিসুল হক:

 মজাটা মজ্জা হয়ে গেল!

 রফিকুন নবী: এইটা থেকে আর বের হতে পারি না। তো এদিকে পেইন্টিংয়ের একটা জগৎ; ওদিকে আরেকটা—এই কার্টুনের...

 কার্টুনের জগৎ। আর একদম প্রথম দিক থেকে যে জগৎটা সাথে সাথে চলে আসছে, বাঁচার ব্যাপারে সহায়ক—সেটা হলো এই বইপত্রের ইলাস্ট্রেশন, প্রচ্ছদ।

আনিসুল হক:

শিক্ষকতাও তো থাকল...

রফিকুন নবী: শিক্ষকতা হলো—আবার এটা আলাদা।

আনিসুল হক:

লেখক হিসেবে তো আপনার ছড়া আমি খুবই পছন্দ করি।

 রফিকুন নবী: লেখক হলে তো লেখক হওয়ার জন্য বা…

আনিসুল হক:

আপনার রম্যরচনা ভালো—আমরা প্রকাশ করি। আপনার ভ্রমণকাহিনি ভালো।

রফিকুন নবী: এগুলো দেয়ালপত্রিকার প্র্যাকটিস থেকে আস্তে আস্তে—এটা করলে মজা হলো যে, ইলাস্ট্রেশন প্রচ্ছদ—এগুলো বড় লেখকদের হাতে লেখা। তখন ‘কম্পিউটারই’ ছিল না। হাতে লেখা, পাণ্ডুলিপিটা ইলাস্ট্রেশনের জন্য আমার কাছে প্রথম আসত।

আনিসুল হক:

হ্যাঁ।

 রফিকুন নবী: তো সম্পাদকেরাও পড়ত না। আমার কাছে ইলাস্ট্রেশনের জন্য এসেছে—আদ্যোপান্ত—আমি প্রথম পাঠক। অনেক সময় বলতাম, বিশেষ করে বিচিত্রায়—হ্যাঁ, এটা ভালো।

আনিসুল হক:

স্যার, আর তিনটা প্রশ্ন আছে আমার। একটা হচ্ছে, আর্টিস্টদের তো অনুপ্রেরণা লাগে—বড় আর্টিস্টদের জীবনীতে, বিদেশি, পাবলো পিকাসোর জীবনীতে নারীর প্রসঙ্গ বারবার ফিরে আসে। এ বিষয়ে আপনার...?

রফিকুন নবী: নারী—একটা বিষয় বটে। এটা এটাই যে দুই প্রজাতির মানুষের মধ্যে ঘটনাটা নিয়ে বেশি...একটা হলো কবিরা, আরেক হলো...

আনিসুল হক:

শিল্পীরা...

 রফিকুন নবী: সেই ছবি আঁকিয়েরা—ছবি আঁকিয়েরা আবার এক ধাপ বাড়া, তারা নুড আঁকবে; এই ধরনের সব ঘটনা আছে। তো এটা আসলে যদি একদম প্রথম থেকে শুরু করি—সেই গুহাচিত্রের মানুষগুলো যে ছবি আঁকত, কী অসাধারণ ড্রয়িং! আমরা যা-ই করি না কেন—মানুষের অবয়ব, জীবজন্তুর অবয়ব—তাদের যে, সব কী বলে যে, প্রপোরশন; এই রেখা কত রকম হতে পারে…এগুলোতেই তো আসলে জ্ঞান-গরিমা বেড়েছে। প্রথম তো, অত মেয়ে চরিত্র আঁকত না। শিকারি আঁকত, ওগুলো একরকম। কিন্তু বাইসনটা...রিয়েলিটি, অনেকটাই রিয়েলিটি। আর মানুষগুলো হলো মানে চিহ্নিত করে যে এরা মানুষ—একটা ধরনের স্টাইল।

আনিসুল হক:

সিম্বল।

 রফিকুন নবী: এটা ধীরে ধীরে মানুষ কী করে যেন পেয়ে গেল। আরে, এই কাছাকাছি থাকা—এই নারীদের নিয়ে তো এটা একটা বিষয় হতে পারে। ভাবল, এইটা গ্রিকদের ঘটনা; তারা নারীকে ওই যে দেবী—

আনিসুল হক:

হুঁ।

রফিকুন নবী: সেই দেবীদের মানে একটা ক্ল্যাসিক ফর্ম করল। সৌন্দর্য যে—এইটা হলে মানে...‘টেমা’ খাওয়া মানুষ নয়! এইটা একটা—এ রকম করলে ভালো হবে। রিয়েলিটির চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে কী করা যায়? সুন্দরী করতে হবে। ওভার-সুন্দরী। মানে, এ রকম—রোজ যে মানুষগুলোকে দেখেছে—এইটা না। সেভাবে—ওই খান থেকে কিন্তু ওরা তো স্কাল্পচার; ছবিতে আবার এটা হতো না।

আনিসুল হক:

না। কিন্তু আপনার জীবনে নারীর প্রেরণা আছে কি না?

 রফিকুন নবী: এই তো আমরা ওয়ান-টাইমার আর ওয়ান-ট্র্যাক—না। ওখানে নারী বলা যাবে না; গিন্নি বলা যাবে। গিন্নি সর্বস্ব, একটা স্ট্রেট-লাইনের জীবন। সেখানে তো ইন্সপিরেশন—এদিক থেকে পাওয়া একটা বড় কথা। সময় দেওয়া ছবি আঁকার জন্য—এইগুলা নিয়ে ভাবতে, সময় দেওয়া—এইগুলা একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু ওই যে, যেই অর্থে প্রশ্নটা ছিল, সেটা আর হলো না।

আনিসুল হক:

হলো না? হ্যাঁ। আচ্ছা, দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে—৮২ বছরের জীবন, ছবি আঁকেন; খ্যাতিমান। দেশের সবাই আপনাকে চেনে—যখন কার্টুন বা বিচিত্রা বেশি জনপ্রিয় ছিল; তখন আপনার সেলিব্রিটি ইমেজ আরও বেশি পপুলার; এখন হয়তো আর্টিস্ট ইমেজটা বড় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যেমন ছাত্রছাত্রীরা, সাধারণ মানুষ—সবাই সংবাদপত্রের কারণে হোক, সবাই আপনাকে একনামে চেনে। কাজেই আপনি কি নিজেকে সফল একজন শিল্পী ভাবেন, নাকি...কখনো কখনো মনে হয় যে ‘কী হলো?’

রফিকুন নবী: শেষেরটাই ঠিক: কোনো আর্টিস্টই আসলেই কক্ষনো—আমার ধারণা, এটা ভাবেন না, ‘একটা তৃপ্তি হয়ে গেল।’ এটার শেষ নেই, আর দারুণ হয়ে গেল—এই যে ‘এই ছবি দিয়েই সব শেষ?’ এটা কখনোই ভাবার মতো অবস্থা হয় না। তা না হলে পরবর্তী ছবিতে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই হতো না—একটার পর একটা ছবি করে যেতে হতো না।

আনিসুল হক:

যখন একটা ছবি—মানে, আমার ক্ষেত্রে যা হয়, আমি যখন একটা উপন্যাস—বড় উপন্যাস লিখতে শুরু করি, আমি ভাবি: ‘এই উপন্যাসটাই হচ্ছে?’ এটা দিয়েই আমি...‘এবার আমার হবে।’ কিন্তু তারপর, যখন শেষ হয়ে বের হয়ে যায়, কিছুদিনের মধ্যে বুঝি—এটা একটা ফাঁকিবাজি কাজ, এটা একটা ব্যর্থ কাজ হয়ে গেল।

রফিকুন নবী: এক্স‌্যাক্টলি।

আনিসুল হক:

তাইলে কী করব? তাইলে আরেকটা লিখি।

 রফিকুন নবী: এইটা হবেই। এইটা যার না হবে, ডেফিনেটলি তারটাই একখানে স্টপ হয়ে যাবে। এটা থাকতে হবে। না হলে রবীন্দ্রনাথ এত লিখলেন কেমন করে? এটা মানে...বিরাট গোলাঘর, রবীন্দ্রনাথের ভেতরটা—তার অনেক জানালা: এদিকে দিয়ে পাখি উঠছে, ওদিকে থেকে...মানে, সে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড। আমি অবাক হয়ে যাই—রবীন্দ্রনাথকে দেখলে...ভাবা যায় না।

 তিনিও শেষ পর্যন্ত বলেছেন, হলো না।

আনিসুল হক:

কিছুই তো হলো না...

 রফিকুন নবী: অনেক কিছু রয়ে গেল। যাহা পাই, তাহা ভুল করে পাই; যাহা চাই, তাহা পাই না। ...এ রকমই কথাটা না?

বাবার চাকরিসূত্রে শৈশবে বিভিন্ন জেলায় ঘুরেছেন রফিকুন নবী
ফাইল ছবি: প্রথম আলো
আনিসুল হক:

হ্যাঁ। এখন আমার শেষ প্রশ্ন: আপনি ’৪৩ সালে জন্মগ্রহণ করলেন—মানে ব্রিটিশ আমলে। তারপর দেশভাগ দেখেছেন। এটা একটু মনে আছে। ’৫২টা মনে আছে, ’৬০-এর দশকের আন্দোলনগুলোতে যুক্ত হলেন। ’৭১-এর আগের আন্দোলনগুলোতে যুক্ত ছিলেন। পরে বিদেশ থেকে এলেন। বাংলাদেশে অনেক পরিবর্তন দেখছেন। দেশটা নিয়ে আপনার কী মনে হয়?

 রফিকুন নবী: আমি তো শিল্পী হিসেবে যখন দেখব, তখন আমাদের দেশটার মতো এত সুন্দর দেশ আর নাই। কিন্তু আমি তো সারা পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছি—সুযোগ পেলেই গেছি, আর প্রত্যন্ত অঞ্চলে তো ঘুরেছি। আমাদের সবকিছু আছে: সাগর আছে, এতগুলো নদী আছে, পাহাড়-পর্বত রয়েছে, এত গ্রিন; আবার কোথাও ড্রাই; যে যা পছন্দ করবে, সেইটাই আছে! সবকিছু আছে। এইটার মানে—ফল-ফসলেও কিন্তু খুবই সমৃদ্ধ থাকার কথা। সেই দেশে...এইটুকু দেশ, সেটার পরিচালন যদি ভালো হয় সব সময়। ডেফিনেটলি আমি মনে করি, ‘আমাদের মতো এই সুন্দর দেশ আর দুটি পাওয়া যাবে না।’

আনিসুল হক:

এখন এটা হচ্ছে, ওই যে র‍্যাপিড ফায়ার—একটাই প্রশ্ন, হ্যাঁ বা না দিয়ে উত্তর দেবেন: আপনাকে যদি বেছে নিতে বলা হয়—পুরান ঢাকা, নাকি চাঁপাইনবাবগঞ্জ—কোনটা বেছে নেবেন?

রফিকুন নবী: আমি তো চাঁপাইনবাবগঞ্জে যেতে রাজি। ওদিকে যাব এই কারণে যে—এই পুরান ঢাকা তো ঠিক আছে। পুরান ঢাকায় তো দুইটা জায়গা থেকে কিন্তু নির্যাস নেওয়া—আমার যাবতীয় রং বলি, লাইন বলি, কম্পোজিশন বলি, সাবজেক্ট বলি, বিষয় বলি—যাবতীয় হয় একবার এখান থেকে নিয়ে, না হয় একবার ওখান থেকে নিয়ে—টোকাই দাঁড়িয়ে গেছে পুরান ঢাকার ওপর দিয়ে, আবার ছবি দাঁড়িয়ে গেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওপর দিয়ে। দুইটা মিলে, প্লাস-মাইনাসে যা হয়—হয়ে গেছে। এটা আমি...

আনিসুল হক:

টোকাই তো ‘সেন্স অব হিউমারে’ ভরা। এটা মনে হয়, আপনার পুরান ঢাকাও হয়তো একটা কারণ—এত রসবোধ। আমার মনে হয়...

রফিকুন নবী: চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষও খুব রসিক।

আনিসুল হক:

ওরাও রসিক। আপনি কী, স্যার, দুইটা ভাষাই পারেন? চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভাষাও পারেন, পুরান ঢাকার ভাষাও?

রফিকুন নবী: হ্যাঁ। ওটা তো...আমার মা তো এখন নেই। মা তো একদম পুরা চাঁপাই ছিলেন; উনি ওখান থেকে সরেননি। বাবাও তা-ই ছিলেন। কিন্তু বাবা মোটামুটি চাকরির বিভিন্ন ইস্যুর কারণে নানা রকম মিশ্রণ হয়ে যায়...আর আমার আত্মীয়স্বজন—যারা চাঁপাইনবাবগঞ্জে থাকে—তারা তো এবার খাঁটি ওই ভাষা। আর মোটামুটি...এই ঢাকার ভাষা—সেটা থেকে কিন্তু ‘টোকাই’ ওই খান থেকে।

আনিসুল হক:

টোকাইয়ের কতগুলো সংলাপ তো আমি ভুলি না। আমি তো ছোট ছিলাম—যখন ধরেন, তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। একটা বলছে যে—‘আম, আগে তো আম শ হিসেবে কিনতাম...এখন তো আম গুনে গুনে কিনতে হচ্ছে। “আর কয়েক দিন পরে ইঞ্চি মাইপা কিনতে হইব।” তারপরে একটা আছে, “সীমান্তের ওপরে টাওয়ার বানিয়েছে ওয়াচ টাওয়ার...”’

রফিকুন নবী: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

বলে—‘ইলিশ খাচ্ছি রে...’

রফিকুন নবী: এইটা কলকাতাতেও খুব আলোচিত—এই সময়ের আলোচিত। ওদের খুব—‘আপনি আমাদের ডুবিয়েছেন’—এ রকম একটা…কার্টুন এঁকেছেন।

আনিসুল হক:

আরেকটা ছিল, শুনেছিস, গরিব শিশুরা ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। টোকাই উত্তর দিল, ‘বড় আছিলো কবে?’

রফিকুন নবী: হ্যাঁ, টোকাই যেটা সব সময় বলেই এসেছি—যেহেতু এতটুকু ছেলে তো, এইটুক ছোট মুখে বড় কথা বলা! ওইটাতে এই যে—ফিলোসফি, এই মহাশূন্যে কী হচ্ছে না হচ্ছে; এই আমাদের দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে...সবকিছু নিয়ে বলে। সোশিওপলিটিক্যাল ঘটনাবলি নিয়ে বলে। কিন্তু ও তো রাজনীতি করে না; রাজনীতিবিদ না। কিন্তু ভাবলে রাজনীতিবিদেরাও ওই খান থেকে রসদ নিতে পারে।

আনিসুল হক:

নিশ্চয়ই পারে।

রফিকুন নবী: এটা টোকাইয়ের একটা ভাব ছিল।

আনিসুল হক:

আমরা এতক্ষণ আমাদের শিল্পগুরু রফিকুন নবীর সঙ্গে অনেক কথা বললাম এবং তাঁর মূল্যবান সময় কিছুটা অপচয়ই হলো; কিন্তু আমাদের জন্য পরম লাভ হলো। আমরা মোটামুটি তাঁর জীবনের অনেক গল্প শুনতে পারলাম। সুধী ‘অভিজ্ঞতার আলো’—এই অনুষ্ঠান থেকে আজ আমরা এখানেই বিদায় নিচ্ছি। আপনারা সবাই ভালো থাকবেন; স্যার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

রফিকুন নবী: ধন্যবাদ সবাইকে।