মাদক বেড়েছে, জড়িত রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জরিপে উঠে এসেছে, ৭৪% মানুষ মনে করেন, আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে মাদক নিয়ন্ত্রণে থাকবে। 

মাদক
প্রতীকী ছবি

মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও মানুষ মনে করেন, তাঁর আশপাশের এলাকায় মাদক চোরাচালান বেড়েছে। মানুষ আরও মনে করেন যে কাজ না পেয়ে সাধারণ মানুষ মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। আর মাদক ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশ রাজনৈতিক দলের কর্মী ও প্রভাবশালী। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি জরিপভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদনে মানুষের এই মতামত উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ৩২ জেলার মাদক পাচারের চিত্র এবং চোরাচালান মোকাবিলায় সমন্বিত কৌশল নির্ধারণ’ শীর্ষক এই জরিপে ৫ হাজার ৪৭০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

সাক্ষাৎকারদাতাদের মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিনিধি, বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সীমান্তবর্তী জেলার সাধারণ মানুষ, বিদেশে যাতায়াতকারী পরিবহনের চালক, মাদকসেবী, স্থানীয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও স্থানীয় বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মীরা রয়েছেন।

উত্তরদাতাদের সবচেয়ে বেশি, ৫২ শতাংশ স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিনিধি। ১৯ শতাংশ বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। 

জরিপে দেখা যায়, উত্তরদাতাদের ৩০ শতাংশ বলেছেন, তাঁদের এলাকায় মাদক চোরাচালান বেড়েছে। ৫ শতাংশ বলেছেন, মাদক চোরাচালান আগের মতোই আছে। ৫ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত নন। বাকিরা প্রশ্নটির উত্তর দেননি। 

আরও পড়ুন

কারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত—সে সম্পর্কে মানুষের ধারণাও উঠে এসেছে জরিপে। ৪১ শতাংশ বলেছেন, মাদক পাচারে জড়িতরা স্থানীয় কর্মসংস্থানহীন দরিদ্র মানুষ। ৩০ শতাংশ মনে করেন, জড়িতরা রাজনৈতিক দলের কর্মী। তাঁরা নিজেদের সেই পরিচয় দেন। ২৬ শতাংশ মনে করেন, মাদক পাচারে জড়িত শিক্ষার্থীদের একাংশ। 

দেশের সব জায়গায় হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যায়। মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারের শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। 
মুহাম্মদ উমর ফারুক, অধ্যাপক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিরোধ শাখার উপপরিচালক মানজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্ত দিয়ে যাঁরা দেশে মাদক নিয়ে আসছেন, তাঁদের গডফাদার এবং অর্থায়নে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কাজটি চলছে। তিনি বলেন, গবেষণায় যেসব তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে এবং যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতি অর্থবছরেই একটি করে গবেষণা করে। গবেষণাগুলোতে নানান ধরনের চিত্র উঠে আসে। নানান সুপারিশও থাকে। কিন্তু মাদক নিয়ন্ত্রণে সাফল্য আসছে না। নতুন জরিপে দেখা যাচ্ছে, মাদক বেড়েছে বলেই মনে করেন মানুষ। 

৩৮৯টি কেন্দ্র

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জরিপটিতে দেশের সীমান্তবর্তী ৩০ জেলার ৩৮৯টি জায়গা (পয়েন্ট) দিয়ে মাদক আসছে বলে উল্লেখ করা হয়। সবচেয়ে বেশি জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে দিনাজপুরে, ৪৩টি। ফেনীর ৩৮টি জায়গা দিয়ে মাদক আসছে। ২০টির বেশি করে জায়গা রয়েছে ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, যশোর ও খাগড়াছড়ি জেলায়। 

রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাট, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, কক্সবাজার, বান্দরবান, কুমিল্লা, রাঙামাটি, জামালপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলা দিয়েও মাদক চোরাচালান হয়। 

সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে প্রায়ই মাদকের চালান ধরা পড়ে। মাঝেমধ্যে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরাও মাদকসহ ধরা পড়েন। যেমন ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে গত মে মাসে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আল মনসুর দেড় হাজার ইয়াবা বড়িসহ গ্রেপ্তার হন। পেশায় সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী মনসুর মাদকের ব্যবসাও করতেন। 

অনেকেই মনে করেন, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের মাসোহারা দেওয়া ছাড়া স্থানীয়ভাবে মাদক ব্যবসা করা কঠিন। 

আরও পড়ুন

অবৈধ আয় অনেক

মাদক কারবারে অবৈধ আয় কেমন, তার একটি ধারণাও উঠে আসে জরিপে। দেখা যায়, খুব অল্প দামে মাদক কিনে চড়া দামে বিক্রি করে বিপুল অবৈধ অর্থ আয় করেন মাদক পাচারে জড়িত ব্যক্তিরা। 

যেমন কক্সবাজারের মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় একটি ইয়াবা বড়ি যে দামে কেনাবেচা হয়, তার প্রায় তিন গুণ দাম পাওয়া যায় স্থানীয় উপজেলা সদরে। জেলা শহরে তার দাম ওঠে পাঁচ গুণ। তবে রাজধানীসহ অন্য জেলায় দাম আরও বেশি, কখনো কখনো সীমান্তের ১০ গুণ। 

দেশে মাদকের মধ্যে বেশি বিস্তার ঘটেছে গাঁজা, ইয়াবা, কোডিন সিরাপ (ফেনসিডিল), আইস, হেরোইন ইত্যাদির। 

শাস্তি জরুরি

জরিপে উঠে এসেছে, উত্তরদাতাদের ৮৪ শতাংশ মাদক নিয়ন্ত্রণবিষয়ক দেশের প্রচলিত আইন সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না। তবে ৭৪ শতাংশ মনে করেন, দেশের প্রচলিত আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

সীমান্ত দিয়ে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি সুপারিশ করেছে গবেষক দল। এর মধ্যে রয়েছে মাদকসেবীদের মাদকের পথ থেকে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে চাহিদা কমানো, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো ও অবৈধ লেনদেনের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। 

জরিপে উত্তরদাতারা বলেছেন, মাদক কেনাবেচার ৩০ শতাংশ অর্থ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাধ্যমে হচ্ছে। বাকিটা হয় নগদ টাকায় ও অন্যান্য উপায়ে। 

‘মাদক কমে না’

মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারের শূন্য সহিষ্ণুতা (জিরো টলারেন্স) নীতি রয়েছে। এর অংশ হিসেবে ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগান নিয়ে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হয় ২০১৮ সালের মে মাসে। মাদক নিয়ন্ত্রণে যুক্ত সংস্থা ও বাহিনীগুলোর অভিযানে দুই বছরে ৫৮৬ জন সন্দেহভাজন মাদক কারবারি বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন। কিন্তু মাদক এখনো হাতের নাগালে। 

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়ছে, এটা বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। দেশের সব জায়গায় হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যায়। মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারের শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারের যে কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটিও বাস্তবায়ন করা হয় না। ফলে ভারত ও মিয়ানমার থেকে মাদক আসছেই।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গবেষণা প্রসঙ্গে উমর ফারুক বলেন, প্রতিবছর তারা যে গবেষণা করে, সেটিও খুবই দায়সারা। গবেষণা করতে হয় বলেই তারা করছে। 

জরিপে এসেছে, তরুণদের মধ্যে মাদকসেবী বেশি। বড় সব বয়সীর মধ্যেই মাদকসেবী রয়েছে। পরিবারের কেউ মাদকাসক্ত হলে সেই পরিবারের দুর্দশার কোনো শেষ থাকে না। যেমন গত ২২ আগস্ট ঢাকার দনিয়ায় মাদকসেবী ভাইকে নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া নিয়ে বিতণ্ডার এক পর্যায়ে ছুরিকাঘাতে খুন হন বড় বোন।