কুমুদিনী ১৯৪৮ সালেই ক্যানসার চিকিৎসার যন্ত্র বসায়
বাংলাদেশের মানুষের ক্যানসার চিকিৎসার জন্য কুমুদিনী হাসপাতালে ১৯৪৮ সালে প্রথম রেডিওথেরাপি যন্ত্র বসানো হয়। এর মধ্যে ৭৬ বছর পেরিয়েছে। এখনো ক্যানসার বাংলাদেশে পর্বতপ্রমাণ সমস্যা হয়ে আছে। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
আজ বুধবার টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ক্যাম্পাসে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক ক্যানসার ও প্যালিয়েটিভ সেবা সম্মেলনে এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলন যৌথভাবে আয়োজন করেছে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিমনস বিশ্ববিদ্যালয় ও ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল। সম্মেলনে দেশি-বিদেশি প্রায় ৩০০ ক্যানসার ও প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ অংশগ্রহণ করেন।
সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ বিমলাংশু দে বলেন, ক্যানসার চিকিৎসা ও প্রশমন সেবা বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। ক্যানসার বাংলাদেশের জন্য এখন পর্বতপ্রমাণ সমস্যা। মানুষের ক্যানসার চিকিৎসা করতে না পারলে মানুষকে প্রশমন সেবা দিতে না পারলে বাংলাদেশ অনেক লক্ষ্যই অর্জন করতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আশার কথা এই যে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করেছি।’
সম্মেলনের প্রথম দিনে আজ একাধিক অধিবেশনে ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা রণদা প্রসাদ সাহার (আরপি সাহা) দূরদর্শিতার কথা তুলে ধরা হয়। ১৯৪৮ সালে কুমুদিনী হাসপাতালে তিনি প্রথম রেডিওথেরাপি যন্ত্র বসিয়েছিলেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পরিচালক শ্রীমতি সাহা বলেন, সম্মেলন শুরুর দিন হিসেবে বুদ্ধপূর্ণিমার দিন বেছে নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কুমুদিনী হাসপাতালে রোগীরা মোনাজাতও করেন। তাই দেখে মনে হয়, এমন তীর্থ আর কোথাও নেই।
নিজের পরিবারের কথা বলতে গিয়ে শ্রীমতি সাহা বলেন, এই পরিবারের ছেলেমেয়েদের ফাইভ স্টার হোটেলে পার্টি না করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, মানুষের সেবা করার জন্য। সব মানুষ কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সঙ্গে থাকলে ট্রাস্ট আরও অনেক কাজ করতে পারবে।
একই অধিবেশনে শ্রীমতি সাহার ছেলে এবং ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব প্রসাদ সাহা বলেন, শিশুর জন্ম থেকে কুমুদিনী হাসপাতাল সেবা দেওয়া শুরু করে। একজন মানুষের মৃত্যুর সময় যে সেবা দরকার, সেটিও দেয়। কুমুদিনী হাসপাতাল মানুষের মর্যাদাপূর্ণ মৃত্যুতে বিশ্বাসী। এর জন্য সব ধরনের আয়োজন এ হাসপাতালে আছে।
এ অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী রোকেয়া সুলতানা। তিনি বলেন, শান্তিতে, ব্যথা না নিয়ে যেন মৃত্যু ঘটে, এটাই প্যালিয়েটিভ কেয়ার।
প্যালিয়েটিভ কেয়ার
এ সেবা সম্মেলনের মূল বিষয় দুটি—একটি ক্যানসার ও ক্যানসার চিকিৎসা এবং অন্যটি প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমন সেবা। অধিবেশনে জানানো হয়, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পক্ষ থেকে নারায়ণগঞ্জে একটি ক্যানসার হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে এবং পাশাপাশি ক্যানসার গবেষণায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রশমন সেবাকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ সম্মেলনের মাধ্যমে তারা বিষয়টি নিয়ে বৈশ্বিকভাবে যুক্ত হতে চাচ্ছে।
প্যালিয়েটিভ কেয়ার–বিষয়ক এক অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নিজামউদ্দীন আহমেদ বলেন, প্যালিয়েটিভ কেয়ারের ধারণা এখনো অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। এটা কি সহায়তামূলক সেবা হবে নাকি সমন্বিত সেবার অংশ হবে, তা নিয়ে দ্বিমত আছে। তিনি বলেন, কমিউনিটিকে যুক্ত না করে ওপর থেকে চাপিয়ে দিলে প্যালিয়েটিভ সেবার উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। কাজটি করতে হবে জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
এ অধিবেশনে আরও বলা হয়, বিশ্বের যত মানুষের প্যালিয়েটিভ কেয়ার দরকার, তার মাত্র ১৪ শতাংশ মানুষ এটা পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোতে এ হার আরও অনেক কম।
কুমুদিনী নার্সিং কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল শেফালী রাণী সরকার ও জ্যেষ্ঠ সিস্টার কৃপা মারিয়া বাড়ৈ দুটি উপস্থাপনা দেন। কমিউনিটিতে তারা কীভাবে কাজ করছেন, সেগুলোই তাতে তুলে ধরা হয়।
কীভাবে রেডিওথেরাপির মাধ্যমে প্রশমনসেবা দেওয়া যায়, তার বর্ণনা দেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত অরুণ মহাদেভান।
ক্যানসার নিয়ে ছয় অধিবেশন
রেডিয়েশন থেরাপি, স্তন ক্যানসার, জরায়ু ক্যানসারসহ সম্মেলনের প্রথম দিনে ক্যানসার নিয়ে ছয়টি অধিবেশন হয়। একটি অধিবেশনে বলা হয়, স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি দেওয়ার সময় কমিয়ে আনার জন্য ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে গবেষণা চলছে। আগে রেডিওথেরাপি দেওয়া হতো তিন থেকে পাঁচ সপ্তাহ। এখন সেটা এক সপ্তাহে নামিয়ে আনা হয়েছে। স্তন ক্যানসার চিকিৎসায় পাঁচ দিন রেডিওথেরাপি দিলে যথাযথ ফল পাওয়া যায় কি না, সেই গবেষণাও চলছে।
ক্যানসারের একটি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য কামরুল হাসান খান। তিনি বলেন, মেলানোমা হচ্ছে নীরব ঘাতক। এটি শরীর উপরিভাগে হওয়া একধরনের টিউমার–জাতীয় সমস্যা।
জরায়ু ক্যানসার–বিষয়ক অধিবেশনে ক্যানসার–বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, দেশে এইচপিভির প্রাদুর্ভাব ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এইচপিভি মূলত জরায়ু ক্যানসারের জন্য দায়ী।
একই অধিবেশনে বিএসএমএমইউর অধ্যাপক ফৌজিয়া হোসেন বলেন, বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ কোটি নারী জরায়ু ক্যানাসারের ঝুঁকিতে আছেন। এই অধিবেশনেই বলা হয়, বাংলাদেশ একটি ‘বোমার’ ওপর বসে আছে। এটি আসলে ক্যানসার।