সেবা নেই, হাজার কোটি টাকা আদায়

ওয়াসার বিদ্যমান পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা পুরো ভেঙে পড়েছে। অপরিশোধিত পয়োবর্জ্য খাল-নদীতে মিশছে।

ঢাকা ওয়াসা গত তিন অর্থবছরে গ্রাহকদের কাছ থেকে পয়োনিষ্কাশন (স্যুয়ারেজ) বিল আদায় করেছে ১ হাজার ৬৬ কোটি টাকার বেশি। অথচ ওয়াসার বিদ্যমান পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা প্রায় অকার্যকর। ফলে অধিকাংশ পয়োবর্জ্য কোনো না কোনো পথে খাল ও নদীতে যাচ্ছে। একদিকে সেবা না দিয়ে গ্রাহকদের থেকে বিল নেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে এসব অপরিশোধিত পয়োবর্জ্য মিঠাপানির উৎস দূষিত করছে।

নগরবিদ, স্যানিটেশন বিশেষজ্ঞ ও ওয়াসার কর্মকর্তারা বলেছেন, গত ৫০ বছরেও ঢাকায় কোনো কার্যকর পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ৮০ শতাংশের বেশি এলাকায় পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। বিদ্যমান পয়োনালাগুলোর বেশির ভাগই অকেজো।

চলতি বছরের ১৪ মার্চ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নগরভবনে নিরাপদ পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালায় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ঢাকা ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন নেটওয়ার্ক কার্যকর নয়। অথচ ওয়াসা পানির বিলের সমান পয়োনিষ্কাশন বিল আদায় করছে। জনগণ কেন এ টাকা দেবে?

প্রথম আলোকে বলেন, সেবা না দিয়ে ঢাকা ওয়াসা পয়োনিষ্কাশনের বিল নিচ্ছে, যা একেবারে অনৈতিক। যেমন একটি আবাসিক ভবনে পানির বিল ৫০ হাজার টাকা আসে, কিন্তু পয়োনিষ্কাশনসহ সেই বিল দিতে হয় এক লাখ টাকা। অথচ বাকি ৫০ হাজার টাকার জন্য কোনো সেবা দেওয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে পরিবেশদূষণও করছে ঢাকা ওয়াসা। পয়োবর্জ্য সব খাল-নদীতে যাচ্ছে।
মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক

ওই কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা ওয়াসার পরিচালক (উন্নয়ন) আবুল কাশেম। তিনিও ওয়াসার পয়োবর্জ্য ব্যবস্থা অনেক পুরোনো উল্লেখ করেন, যার অধিকাংশই অকেজো।

এমন অকেজো পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা রেখে পানির বিলের সমপরিমাণ অর্থ আদায় করা হচ্ছে। ওয়াসার আয়-ব্যয় বিবরণীর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১—এ তিন অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসা পয়োনিষ্কাশন বিল আদায় করেছে ১ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ অর্থবছরেও প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বিল আদায় হয়েছে বলে ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে।

পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থায় বাণিজ্যিক ও আবাসিকে উৎপাদিত পয়োবর্জ্য নালার মাধ্যমে শোধনাগারে নেওয়া হয়। সেখানে পরিশোধিত বর্জ্য খাল বা নদীর মতো পানির উৎসে ফেলা হয়। ঢাকায় ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে কিছু এলাকায় পয়োনিষ্কাশনের নালা তৈরি করা হয়। হাজারীবাগ, লালবাগসহ পুরান ঢাকার বেশির ভাগ এলাকা, ধানমন্ডি, মগবাজার (আংশিক), লালমাটিয়া (আংশিক), বাসাবো, গেন্ডারিয়া ও গুলশান-বনানী (আংশিক) এলাকায় পয়োনালা রয়েছে। আর কোথাও পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা হয়নি।

ওয়াসার কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা বলছেন, কোনো ধরনের সংস্কারকাজ না হওয়ায় ওয়াসার বিদ্যমান পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা পুরো ভেঙে পড়েছে। তাঁদের হিসাবে, গত ১৩ বছরে পয়োনিষ্কাশন বিল বাবদ ঢাকা ওয়াসা গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা আদায় করেছে।

পাইপলাইন থাকা মানেই সব না, তা কার্যকর তো থাকতে হবে। পয়োনিষ্কাশন নেটওয়ার্ক অকার্যকর, তারপরও গ্রাহকদের কাছ থেকে বিল নেওয়ার যৌক্তিকতা নেই।
আদিল মুহাম্মদ খান, নগর গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বর্তমানে ইউনিসেফের স্যানিটেশন পরামর্শক। তাঁর গত বছরের একটি গবেষণাপত্রের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর ২ ভাগের কম পয়োবর্জ্য পরিশোধন হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসার আওতাধীন জনসংখ্যা এক কোটি হিসাবে রাজধানীতে দৈনিক ৯১০ মিলিয়ন লিটার পয়োবর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ৯০০ মিলিয়ন লিটার অপরিশোধিত পয়োবর্জ্য সরাসরি মিঠাপানির উৎসে চলে যায়।

এ বিষয়ে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সেবা না দিয়ে ঢাকা ওয়াসা পয়োনিষ্কাশনের বিল নিচ্ছে, যা একেবারে অনৈতিক। যেমন একটি আবাসিক ভবনে পানির বিল ৫০ হাজার টাকা আসে, কিন্তু পয়োনিষ্কাশনসহ সেই বিল দিতে হয় এক লাখ টাকা। অথচ বাকি ৫০ হাজার টাকার জন্য কোনো সেবা দেওয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে পরিবেশদূষণও করছে ঢাকা ওয়াসা। পয়োবর্জ্য সব খাল-নদীতে যাচ্ছে।

পয়োনিষ্কাশনের জন্য ২০১৩ সালে মহাপরিকল্পনা তৈরি করে ঢাকা ওয়াসা। এতে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা অকার্যকর হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। পয়োবর্জ্য পরিবহনের প্রধান পাইপলাইনটি ‘ট্রাঙ্ক স্যুয়ারস’ নামে পরিচিত। ঢাকা ওয়াসার তিনটি ট্রাঙ্ক স্যুয়ারস আছে, এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলের লাইনটি আসাদগেট থেকে শুরু করে তেজগাঁও, বাসাবো ও স্বামীবাগ হয়ে পাগলা শোধনাগার পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার। লাইনটি এখন আর কার্যকর নেই বলে ওয়াসার মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে।

মোহাম্মদপুর থেকে শুরু করে হাজারীবাগ, নীলক্ষেত, সেগুনবাগিচা, পুরোনো পল্টন ও মতিঝিল হয়ে আরেকটি ট্রাঙ্ক স্যুয়ারস নারিন্দা পৌঁছেছে। মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, এ লাইন অকার্যকর থাকায় এর আওতাধীন এলাকার পয়োবর্জ্যগুলো পানিনিষ্কাশনের নালার মাধ্যমে কাছের নিম্নাঞ্চলে ফেলা হচ্ছে।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নবাবগঞ্জ থেকে লালবাগ, জেলখানা গেট, আবুল হাসনাত রোড, নবাবপুর রোড ও টিপু সুলতান রোড হয়ে নারিন্দায় আরেকটি ট্রাঙ্ক স্যুয়ারসের কিছু অংশ অকার্যকর। ওয়াসার বিদ্যমান পাইপলাইনগুলোর ভঙ্গুর দশা এবং অধিকাংশের ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে বলে মহাপরিকল্পনাতে উল্লেখ করা হয়েছে।

গত ১৮ মে এক মতবিনিময় সভায় ঢাকার চারপাশের নদীদূষণের জন্য ঢাকা ওয়াসাকে দায়ী করেন নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসা বাড়িঘরের পয়োবর্জ্যের সংযোগ পানিনিষ্কাশনের লাইনের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে।

অকার্যকর পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা নিয়ে জানতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান এবং পরিচালক আবুল কাশেমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া দেননি। গত ২৭ আগস্ট সংস্থাটির উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেকের মাধ্যমে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হয়। তবে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসা জবাব দেয়নি।

ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, পয়োবর্জ্য পরিশোধনের কথা, সেটি হচ্ছে না। দুই কোটি মানুষের শহরে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা নেই, এটি হতাশাজনক। একাধিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এসব প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার।

অকেজো নালা পুনর্নির্মাণে নতুন প্রকল্প

অকেজো পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা পুনর্নির্মাণে একটি নতুন প্রকল্প নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এ প্রকল্পে পাগলা পয়ঃশোধনাগার পুনর্নির্মাণ এবং ৪৬২ কিলোমিটার পয়োনিষ্কাশন লাইন নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করা হবে।

৩ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পে ২ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এ প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৫ শতাংশ।

নগর গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, পাইপলাইন থাকা মানেই সব না, তা কার্যকর তো থাকতে হবে। পয়োনিষ্কাশন নেটওয়ার্ক অকার্যকর, তারপরও গ্রাহকদের কাছ থেকে বিল নেওয়ার যৌক্তিকতা নেই।