সুগন্ধি চালের বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ

চালের দাম কমাতে সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ করে রেখেছে সরকার। রপ্তানিকারকেরা বলছেন, সুগন্ধি চাল কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়। 

বাংলাদেশ থেকে সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ থাকায় দেশীয় কোম্পানিগুলো রপ্তানি বাজার হারাচ্ছে। তারা বলছে, শুধু সুগন্ধি চাল থেকে রপ্তানি আয় বন্ধ তা নয়, এ চালের কারণে অন্যান্য কৃষিপণ্যের রপ্তানি আয়ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ, দোকানে গেলে বাংলাদেশি সুগন্ধি চালের সঙ্গে ক্রেতারা অন্যান্য উপকরণও কিনতেন। 

দেশে দাম বেড়ে যাওয়ায় গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্য মন্ত্রণালয় সুগন্ধি ও সরু চাল রপ্তানি বন্ধ রাখার অনুরোধ জানায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত জুনে সুগন্ধি চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। এর আগে আগাম অনুমতি সাপেক্ষে সুগন্ধি চাল রপ্তানি করা যেত। বাংলাদেশ থেকে ৪১টি প্রতিষ্ঠান চাল রপ্তানি করত।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সুগন্ধি চাল কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) নিত্যপণ্যের তালিকায় সুগন্ধি চাল নেই। সুগন্ধি চালের ক্রেতারাও সচ্ছল। তাই এ চাল রপ্তানি বন্ধ রাখা যুক্তিযুক্ত নয়। 

সুগন্ধি চাল রপ্তানি বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়াতে পারে বলেও মনে করেন রপ্তানিকারকেরা। তাঁরা জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞার আগে তাঁরা এক কেজি সুগন্ধি চাল রপ্তানি করতেন এক থেকে সোয়া মার্কিন ডলার দরে। বাংলাদেশি মুদ্রায় দাম পড়ত ৮৫ থেকে ১০০ টাকা। বর্তমান বাজারদরে চাল কিনে রপ্তানি করলে প্রতি কেজির দাম দুই ডলারের কাছাকাছি পাওয়া যাবে। এক কেজি সুগন্ধি চাল রপ্তানির আয় দিয়ে চার কেজি সেদ্ধ চাল আমদানির সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। 

■ বাংলাদেশ থেকে বছরে ১০ হাজার টনের মতো সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়, যা মোট চালের খুব নগণ্য অংশ। 

■ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয় বাংলাদেশি সুগন্ধি চাল। 

বাংলাদেশি সুগন্ধি চালের বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলো, যেসব দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যা বেশি। যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশেও সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ভারত ও পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে বাসমতী চাল রপ্তানি করে। বাংলাদেশের কালিজিরা ও চিনিগুঁড়া চাল বাসমতীর একটি বিকল্প হয়ে উঠছিল। প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেমন এ চাল পছন্দ করেন, তেমনি অন্য দেশের নাগরিকেরাও এ চাল কেনা শুরু করেছিলেন। কারণ, বাংলাদেশি চালের স্বাদ ও সুগন্ধ বাসমতী চালের চেয়ে ভিন্ন। 

উৎপাদন ও রপ্তানি আয় কত

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) হিসাবে, দেশে বছরে সাড়ে তিন কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ সুগন্ধি চাল। সাধারণত কৃষকেরা অন্য ধানের পাশাপাশি কিছু জমিতে সুগন্ধি জাতের ধান আবাদ করেন।

কৃষকেরা বলছেন, সুগন্ধি জাতের ধান আবাদ লাভজনক। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার পুরিয়া গ্রামের কৃষক মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সুগন্ধি ধানের আবাদ বাড়ছে। কারণ, দাম ভালো পাওয়া যাচ্ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে পরিমাণের দিক দিয়ে সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়েছে ৯ হাজার ৫১৭ টন, যা দেশের মোট চাল উৎপাদনের শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশের কম। 

রপ্তানির সুযোগ চেয়ে আবেদন

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, এসিআই, টি কে গ্রুপ, ইফাদ গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সুগন্ধি চাল রপ্তানির সুযোগ চেয়ে আবেদন করে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) কাছে বিষয়টি নিয়ে মতামত চেয়েছে। ট্যারিফ কমিশন সূত্র জানিয়েছে, তারা একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে। তবে রপ্তানির সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর। 

জানতে চাইলে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আগামী বোরোতে আশা করি ধানের ফলন ভালো হবে। এরপর পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা রপ্তানি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’

এদিকে দেশের কৃষিপণ্য রপ্তানি আয় কমছে। ইপিবির হিসাবে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে কৃষিপণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৬২ কোটি ডলারের কিছু বেশি, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ কম।

জানতে চাইলে স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মো. পারভেজ সাইফুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ থাকলে বাংলাদেশ বাজার হারাবে। একবার বাজার হারিয়ে ফেললে সেটা ধরা কঠিন। 


[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, দিনাজপুর]