আমার বাবার যুদ্ধ
শহীদ বুদ্ধিজীবী মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ছিলেন নীরব অথচ দৃঢ় এক সংগ্রামের প্রতীক—যাঁর অস্ত্র ছিল বিশ্বাস, বিবেক ও বাঙালিত্ব। সেই ব্যক্তিগত যুদ্ধের স্মৃতি ও নিষ্ঠুর পরিণতি নিয়ে লিখেছেন তাঁর ছেলে।
সময়টা সম্ভবত ভোর। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর যখন বাবাকে হত্যা করা হয়, তখন তাঁর বয়স ৪৫ বছর ৪ মাস ২২ দিন। বাবা তখন আমার এখনকার বয়সের চেয়ে প্রায় আট মাসের ছোট।
বাবাকে হত্যা করা হয়েছিল তাঁর বুদ্ধি-বিবেচনা আর বিশ্বাসের জন্য। তিনি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। ছিলেন না কোনো বজ্রকণ্ঠী বক্তাও। তিনি কেবল তাঁর ধারণাগুলো খুব সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে জানতেন। তিনি তাঁর অস্তিত্বে বাঙালিত্বটুকু ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। কেবল রাজনৈতিক পরিচয়টা ‘পাকিস্তানি’ বলে চিন্তা-চেতনা-মননে পাকিস্তানি হতে হবে, এমনটা তিনি মানতে পারেননি। একটি সাধারণ বিশ্বাস, অথচ এটাই তাঁকে হত্যা করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
আমার বাবা মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। তিনি ছিলেন এ দেশের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, মেধাবী বিদ্যানুরাগী। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, একজন স্বনামধন্য রবীন্দ্র–গবেষক। ১৯৫০-এর দশকে তমুদ্দুন আন্দোলন যখন তুঙ্গে, পূর্ব পাকিস্তানের কিছু স্থানীয় বুদ্ধিজীবী প্রস্তাব করলেন, বাংলা সাহিত্যে অমুসলিম (বিশেষ করে হিন্দু) লেখকদের কোনো সাহিত্যকর্ম গ্রহণযোগ্য হবে না। বাবা এই অবিবেচক প্রহসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিলেন। যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস থেকে রবীন্দ্রনাথকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
এভাবেই বাবা লড়েছিলেন তাঁর নিজের যুদ্ধে। তিনি এবং তাঁর সমসাময়িক আরও অনেকেই প্রত্যক্ষ রাজনীতিবিদ ছিলেন না। এমনকি ১৯৭১ সালেও মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত ক্লাস নিয়েছেন, দাপ্তরিক কাজও করেছেন। যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ভারতের শান্তিনিকেতনসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীরা ছিলেন। তাঁরা বারবার অনুরোধ করেছিলেন, পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি যেন প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নেন। কিন্তু বাবা তাঁদের কথায় কান দেননি।
বাবার জীবনের শেষ সময়টাই সম্ভবত তাঁর ব্যক্তিত্ব বোঝাতে যথেষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবার ছাত্রদের একজন ছিল চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। ১৪ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনীর যে দলটা বাবাকে তুলে নিতে এসেছিল, মুঈনুদ্দীনও তাদের সঙ্গে ছিল। সে আমার মা, চাচা-চাচিকে কথা দিয়েছিল, বাবাকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। সে বলেছিল, তার শিক্ষকের কোনো ক্ষতি সে হতে দেবে না।
চোখ বেঁধে বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মোহাম্মদপুর শরীরচর্চা কেন্দ্রে। একটা বিশাল বদ্ধ ঘরে বাবাকে ফেলে রাখা হয়েছিল অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীসহ সমমনা আরও অনেকের সঙ্গে। যাঁদের প্রত্যেকের গায়েই পড়েছিল নৃশংস নির্যাতনের চিহ্ন। ছেঁড়া জামাকাপড় রক্তে মাখামাখি, এমনকি উপড়ে ফেলা হয়েছিল কারও কারও চোখ! দেলোয়ার হোসেন ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন। পরের ঘটনা এই প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকেই শোনা।
রাত তখন সাড়ে আটটার কাছাকাছি। লোহার রড হাতে অন্ধকার ঘরটাতে পা রেখেছিল কিছু যুবক। প্রথমে তারা মুনীর চৌধুরীর মুখোমুখি হয়েছিল। বলেছিল, ‘ছাত্রদের তো অনেক কিছু শিখিয়েছেন। আজ আমরা আপনাকে কিছু শিক্ষা দেব।’ তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আপনি কয়টা বই লিখেছেন?’ মুনীর কাকা দুদিকে মাথা নেড়ে বলেছিলেন, তিনি লেখেননি। বাবার কাছেও ছিল তাদের একই প্রশ্ন। বাবা বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি লিখেছি।’ এ কথা শুনেই লোকগুলো লোহার রড দিয়ে তাদের মারতে শুরু করে। সকালের শুরুতেই রুমের ভেতরে যাঁরা ছিলেন—চিকিত্সক, শিক্ষাবিদ, লেখক সবাইকে কাটাসুর নামে এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাঁদের প্রত্যেককে হত্যা করা হয় বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে। দেলোয়ার হোসেন কেবল বেঁচে গিয়েছিলেন।
এই ছিলেন আমার বাবা। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও যিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছি!’
প্রথম আলো, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩
লেখক: শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছেলে