‘রেজা আলী ছিল জীবনের প্রতিভূ’

রেজা আলী

বসুন্ধরায় আজ তার বাড়িতে এসে এই প্রথম মনে হচ্ছে, পাঁচ দিন হলো আমরা রেজাবিহীন পৃথিবীতে বাস করছি।

বেশ কিছুকাল রেজা আলী অসুস্থ ছিল। ঢাকায় হাসপাতালে দেখতে গিয়েছি। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকার জন্য দেখা হয়নি। মরদেহ ঢাকা এসেছে। কিন্তু জানাজার আগে বা পরে তার মুখ দর্শন করিনি। করতে ইচ্ছাও হয়নি। রেজা ছিল জীবনের প্রতিভূ—জীবন-স্পন্দনের মূর্ত প্রতীক। প্রাণহীন অবয়বে তাকে ভাবা দুঃসাধ্য। ওই রূপে তাকে মনশ্চক্ষেও দেখতে চাইনে। জীবনের প্রতিভূ হিসেবেই আমাদের নয়নের মাঝখানে চিরকালের জন্য ঠাঁই নিক।

মনে পড়ে কোনো এক সুরা-সন্ধ্যায় জীবনের অনিশ্চয়তা, বেঁচে থাকার বিড়ম্বনা এ–জাতীয় কিছু গুরু বিষয়ে লঘুভাবেই আলোচনা হচ্ছিল। কথার মধ্যে আমি সম্ভবত আসাদ উল্লাহ খান গালিবের একটি উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম—

‘জিন্দেগি হ্যায় ইয়া কো-ই তুফান হ্যায়?

হাম তো ইস্ জিনে কি হাতোঁ মর চলে—’

কথাগুলো রেজার খুব ভালো লেগেছিল। তার জীবনে তা প্রয়োজন। জীবনের বেঁচে থাকার সব মুহূর্ত নিয়েই তো মরণের আবাহন। ‘হাম তো ইস্ জিনে কি হাতোঁ মর চলে।’ তাহলে প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা ভালো করেই বাঁচি। এই উপলব্ধি রেজার জীবনে ছিল এক বিরাট সত্যি।

রেজার ডাকনাম ছিল পারভেজ। আমার বছর তিনেকের ছোট। আত্মীয়তার সম্পর্কে ভাগনে। কিন্তু বয়স ও সম্পর্কের ব্যবধান অতিক্রম করে আমাদের সম্পর্ক নিকট বন্ধুত্বের কাঠামোতেই চলে এসেছিল নির্বিবাদে। প্রাত্যহিকতার স্বাভাবিকতায়। এর অবশ্য কারণও ছিল। উভয়েরই কিছুটা ত্রিকালদর্শী অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ। তিন রাষ্ট্রব্যবস্থা, তিন পতাকা, তিন সমাজ, সংস্কৃতির ধারা। তা ছাড়া জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির অভিন্নতা। এমনকি রাজনীতির চিন্তাভাবনা ও সমাজদর্শনেও।

পারভেজ বেড়ে উঠেছিল সচ্ছল, স্বাচ্ছন্দ্যে এক রাজনৈতিক পটভূমে। পিতামাতা—দুদিক থেকেই। এখানে উপস্থিত সবাই নিকট আপনজন। নতুন করে বলার কিছু নেই।

সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল, লাহোরের অভিজাত অ্যাচেসন কলেজ। রাজনীতি ও সমাজসচেতন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গণতন্ত্রের সপক্ষে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ। বামঘেঁষা ছাত্ররাজনীতির অপস্রিয়মাণ সীমানা ছাড়িয়ে জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেকটা অলক্ষিত প্রবেশ। জীবনসংগ্রামের সূচনা।

রেজারই প্রতিষ্ঠিত ‘বিটপী’ তার মৃত্যু সংবাদ জানাতে গিয়ে জনসমক্ষে উল্লেখ করেছে—ভালোবাসার স্মৃতিতে আজীবন দুঃসাহসিকতার রেজা আলী ভালোবাসা, বিপ্লব, সৃষ্টিশীলতা ও উদ্যমের পরম্পরা, যথার্থ। আবার সমস্যা দেখলে রেজা যে এড়িয়ে যাবে, তা তো নয়। বরং তার কাছে তা দিচ্ছে সৃষ্টিশীল নৈপুণ্য প্রকাশের একটি সুযোগ, তা ব্যক্তিজীবনেই হোক বা কর্মজীবনে।

ইনাম আহমদ চৌধুরী
ফাইল ছবি

দৃশ্যত, রেজার জীবনের প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো তার প্রেম। গুণবতী–রূপবতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাঈমা মিঠুকে সে ভালোবেসেছিল। এবং তা ছিল দ্বিপক্ষীয়। তবে তাতে ছিল বড় অন্তরায়, বিরাট সমস্যা। ভাগিনা ও আমি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেলাম সে সমস্যা দূরীকরণে। আমি তখন সিভিল সার্ভিসে চট্টগ্রামে কর্মরত। এখনো কানে বাজে অতি ভোরে ঢাকা থেকে সারা বুবুর উদ্বেগাকুল উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর, ইনাম তোমাকে এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে। এবং শুধু তুমিই তা পারবে। মেয়েপক্ষকেও তুমি চেনো। চট্টগ্রামে এ-সম্পর্কিত কিছু প্রয়োজনীয় আলোচনা সেরে অবিলম্বে ছুটি নিয়ে নোয়াখালী। সেখানে নাঈমার শ্রদ্ধেয় বাবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। বিভিন্নমুখী প্রচেষ্টা। সে আরেক উপাখ্যান। মোদ্দাকথা, প্রেমের জয় হলো। ভালোবাসার পাত্রী নাঈমার হাত ধরেই রেজা আলীর জীবনসংগ্রামে প্রবেশ। ক্রমে ক্রমে মিরান, সারাহ, মিশাল—পল্লবিত এক নিটোল সুখী সংসার।

একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য। একটি বিশেষ দিক তাকে আকর্ষণ করেছে, তা হচ্ছে জনকল্যাণ। দৈনন্দিন জীবনের দুরূহ সংগ্রামেও ধ্রুবতারার মতো তা তাকে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। তা দেখি অ্যাডভার্টাইজিং ইন্ডাস্ট্রির পথিকৃৎ হলেও জনস্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা একনিষ্ঠ গণমুখী সমাজ হিতকর কর্মেই তার উদ্যম। অন্যান্য উদ্যোগেও সাংস্কৃতিক লোকগাথা বা জনজীবনের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ গভীর ও বিস্তৃতভাবে প্রবিষ্ট। তৈরি পোশাকশিল্পেও তা-ই। পরিবেশ সংরক্ষক যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তার দুটো ফ্যাক্টরি পৃথিবীর সর্বোচ্চ লিড  Leed Certified Factory হিসেবে স্বীকৃত বৈদেশিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অনারারি কনস্যুলেটগুলো সামাজিকতার পটভূমে এক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। রেজা তার পরিবারে এই সত্যকে স্বীকার করে বহু ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে জোরদার করতে পেরেছে। ময়মনসিংহের ত্রিশালে রেমি ফার্মের প্রতিষ্ঠাতাকে গণমানুষের একদম কাছে নিয়ে এসেছে। ওখানেরই সংসদীয় প্রতিনিধিত্ব তার ছিল। সেখানেই সে বেছে নিয়েছে তার অন্তিম শয়ান। নাগরিক কোলাহল ও আড়ম্বরের বহু দূরে—শান্ত নির্জন পরিবেশে কিন্তু মাটি ও মানুষের কাছে। তার শোকবাণীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন রেজা আলী ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা। হ্যাঁ, এটাই তার আসল ও নির্ভেজাল পরিচয়। আরেকটি বিষয় তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। পৃথিবীতে জানার ও চেনার দুর্নিবার অভিলাষ। তবে চিরাচরিত উপায়ে নয়। অ্যাডভেঞ্চার বা দুঃসাহসিকতার মধ্য দিয়ে তা আবিষ্কার করা। দুর্গম গিরিশৃঙ্গ আরোহণ, অরণ্য-আকীর্ণ আফ্রিকাতে বন্য পশুর সন্ধান—এসব জোগাত তার ঈপ্সিত রোমাঞ্চের উপাখ্যান।

জীবনকে প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসত রেজা। তার Joe de Vivre জীবনতৃষ্ণা ছিল অপরিসীম। এই আনন্দ-বেদনার বিরহ মিলন সংকটের জীবনে ভালোবাসার তীব্রতায় তা থেকে নির্যাস নিংড়ে নিয়ে নিজের ও আপনজনের পৃথিবীকে এক আনন্দলোকে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা তার সারা জীবনে বিধৃত। জীবনে বেঁচে থাকার যে মর্মান্তিক ব্যস্ততা, প্রতি পদে অনিশ্চয়তা, স্বার্থরক্ষার ও সংঘাত উত্তরণের যে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, তা থেকে মাঙ্গলিক এক সুন্দর প্রীতিময় পরিবেশ সৃষ্টি করার আজীবন উদ্যোগ রেজাকে ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যময় করে তুলেছে।

পারভেজ রেজা আলী—এই পরিচয়েই তুমি আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবে চিরকাল।
(প্রবীণ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী রেজা আলী ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর দোয়া মাহফিলে আলোচনায় অংশ নেন সাবেক সচিব ইনাম আহমেদ চৌধুরী। তিনি সেখানেই এ বক্তব্য তুলে ধরেন।)