জামদানির গোপন নকশা
গুপ্তবিদ্যা রহস্যময়; বস্ত্রে ফুটিয়ে তোলা ফুল–লতাপাতার মতো সাধারণ নকশাও যে গুপ্তবিদ্যা হতে পারে, তার উদাহরণ জামদানি। শত শত বছর ধরে জামদানি বোনা হচ্ছে, কিন্তু এর নকশা আঁকা থাকে না। সেই নকশা সংরক্ষিত থাকে তাঁতির স্মৃতির মহাফেজখানায়। অথচ এতে রয়েছে অঙ্কের জটিল হিসাব–নিকাশ।
জামদানি বা মসলিন বোনা হয় গর্ত তাঁতে। একজন ওস্তাদ আর একজন শাগরেদ তাঁতে বসেন। ওস্তাদ স্মৃতি থেকে বলেন নকশা ফুটিয়ে তোলার কৌশল। শুনে শুনে কারুকাজ শাড়ির জমিনে ফুটিয়ে তোলেন শাগরেদ। জামদানির নকশার অনন্যতা হচ্ছে, এর বয়ন আর নকশার যৌথ রূপায়ণের ধরন। কাপড়টি তৈরি হয়ে চলবে, তার সঙ্গে সঙ্গে নকশাও ফুটে উঠতে থাকবে।
এ যেন নানা রঙের সুতার সঙ্গে ঐতিহ্যগত কল্পনার এক মায়াময় বন্ধন। বাংলাদেশের কারুশিল্প আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ প্রয়াত রুবী গজনবী তাঁর ‘জামদানি ঐতিহ্যময় বাংলাদেশের বয়নশিল্প’ প্রবন্ধটি শুরু করেছিলেন এই বলে, ‘ও আমার না আছে জানা টান, না আছে বানা/ না আছে তোমার জালসম বুননের সৃষ্টির ধারণা।’
‘ জামদানির জন্য সুতির সুতা যত বেশি চিকন, কাউন্ট তত বাড়বে। সিল্কে আবার এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সুতার কাউন্ট যত বেশি, সুতা তত বেশি মোটা।’চন্দ্রশেখর সাহা, বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি
এসব কথা জানার সূত্র পাওয়া গেল সেবা নারী ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের উদ্যোগে গত ১৯ থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে চলা ‘অনন্য বয়নে জামদানি উৎসব’ আয়োজনে। এতে সহযোগিতা করেছিল বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদ। উৎসব থেকে ফিরে আমরা ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছি কয়েকজন তাঁতশিল্পীর সঙ্গে।
জানার কৌতূহল ছিল—না লেখা, না আঁকা জামদানির নকশার হিসাব কীভাবে মেলানো হয়? রূপগঞ্জের মো. সেলিম হোসেন বংশপরম্পরায় আদি জামদানি তৈরির কারিগর। সেলিম বললেন, ‘ধরুন, একটি সন্দেশ ফুল তুলতে হবে, তখন মুখে মুখে বলতে হয়, “১৫ খেও ধরো, ডান পাশে বাড়ে এক সুতা, এক সুতা কমে বামে, দশ ঘর পর দুই পাশে বাড়ে দশ সুতা। কমে এক এক করে।” শুনে শাগরেদ ঠিক বুঝে যাবে নকশটাা।’
গুপ্তবিদ্যার মতো এমন জটিল হিসাবের অন্দরের খবর নেওয়ার আগ্রহ আছে অনেকেরই। জামদানি নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করছেন জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি নায়েমের সহকারী পরিচালক সায়মা রহমান। তিনি প্রথম আলোকে জানান, ‘জামদানি শাড়ি বোনার জন্য তাঁতিদের নানা রকমের শ্লোক আছে। এসব লিখে রাখা নেই কোথাও।’ একটা শ্লোক যেমন এ রকম, ‘পাঁচ খেও পিছা ধৈরে, ছয় খেও জিগির রাইখে, ঠেলা মধ্যে আরেক পিছা, ডাইনে গাঢ় এক খেও, বাঁয়ে পিছা বারে এক খেও।’ শাগরেদ এই শ্লোকের মানে বুঝে ঠিকঠাক ফুটিয়ে তোলেন নকশা।
জটিল এই হিসাব আবার সব বস্ত্রে এক নয়। সাধারণ প্রচলিত আর আদি জামদানির মধ্যেই বিস্তর ফারাক। মূল পার্থক্য সুতার ব্যবহারে। সুতার হিসাব ‘কাউন্ট’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি চন্দ্রশেখর সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ জামদানির জন্য সুতির সুতা যত বেশি চিকন, কাউন্ট তত বাড়বে। সিল্কে আবার এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সুতার কাউন্ট যত বেশি, সুতা তত বেশি মোটা।’
এসব হিসাবের পাশাপাশি আছে রঙের বোঝাপড়া। শিল্পকলা একাডেমির ১১ দিনের জামদানি উৎসবে ৫টি কাঁচা রঙের উপস্থিতি ছিল—সুপারি, হরীতকী, নীল, খয়েরি আর মনজিত। এসব প্রাকৃতিক উপাদান থেকে জামদানির সুতার রং করার প্রচলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন রুবী গজনবী।
তবে বিপণনের জন্য অপ্রতুল হওয়ায় এর ব্যবহার এখনো সহজলভ্য হয়ে উঠতে পারেনি। শ্রমসাপেক্ষ এই জটিল বয়নের মধ্য দিয়ে প্রস্তুত এই বস্ত্র ঐতিহাসিকভাবেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মোগলদের হাত ধরে এটি তার উৎকর্ষে পৌঁছেছিল।
রূপগঞ্জের তাঁতি মোমিনুর রহমান বলেন, ‘ঝুমকা পাড়, আমের মৌ বা নিশান—এসব নকশা তৈরি হয় মুখে মুখে। বড় কাজের অর্ডার থাকলে আমাদের ছবি পাঠানো হয়। এর পুরোটাই আমাদের স্মৃতিনির্ভর শিল্পকর্ম।’
ইতিহাসের পরম্পরায় এমন গুরুত্বপূর্ণ বস্ত্র বয়নের সাক্ষী আমাদের দেশের তাঁতিরা। এসব নকশা বলার মতো গুটিকয় মানুষ চলে গেলে তারপর কী হবে এই গুপ্তবিদ্যার?