আগস্ট ট্র্যাজেডির পর দুঃসময়ের সাথি

কার্লসরুয়ে শহরে ড. শহীদ হোসেন ও বলবীর গোয়েল

গত জুন মাসে হঠাৎ করেই ভিয়েনা থেকে ড. শহীদ হোসেন হ্যানোভারে ফোন করলেন। বললেন, ‘আমার স্মৃতিবিজড়িত শহর কার্লসরুয়ে যাব। আপনাকে সঙ্গী হতে হবে।’ আরও বললেন, ড. বলবীর গোয়েলকে যেন আগেই জানিয়ে রাখি।

ইতিহাসের পাতায় অশ্রু দিয়ে লেখা তারিখ ১৫ আগস্ট। একদিকে পরিবারের সবাই নিহত হওয়ার খবর, অন্যদিকে বিদেশেও জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা। চরম আতঙ্ক নিয়ে আগস্টের দিনগুলো কাটে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার। সঙ্গে শিশু জয় ও পুতুল। প্রতিটি দিন কাটে চরম অনিশ্চয়তা আর আর্থিক সংকটে। এরই মধ্যে চলে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান। চরম দুঃসময়ে কেউ দূরে চলে যান, কেউবা পাশে এগিয়ে আসেন। সেই হৃদয়বিদারক পরিস্থিতিতে কার্লসরুয়ে শহরে এগিয়ে এসেছিলেন, শহীদ হোসেন ও বলবীর গোয়েল। ৪৭ বছর আগে তাঁরা হয়েছিলেন দুঃসময়ের সাথি।

বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রাণে বেঁচে যান ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে জার্মানিতে আসার কারণে। জার্মানিতে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে তাঁদের কাটাতে হয়। সে সময় ১০টি দিন তাঁদের কাছে হয়ে উঠেছিল যেন ১০ বছরের সমান।

কঠোর গোপনীয়তায় দিল্লি রওনা হওয়ার আগে শেষ ছয়টি দিন তাঁরা ছিলেন কার্লসরুয়ে শহরে। শহীদ হোসেন ও বলবীর গোয়েল ছিলেন সেই দুঃখভরা দিনগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী। ইতিহাসের এই সাক্ষীদের নিয়ে ওই শহরে গিয়ে তাঁদের স্মৃতিচারণা শোনার ইচ্ছা আমার বহুদিনের।

গত ১১ জুন। কার্লসরুয়ে শহরের প্রধান রাস্তা কাইজার সড়ক ধরে আমরা তিনজন হাঁটছি। আমি এসেছি হ্যানোভার শহর থেকে, শহীদ হোসেন এসেছেন ভিয়েনা থেকে আর বলবীর গোয়েল দীর্ঘ সময় ধরে থাকেন এ শহরেই। কাইজার সড়কের মধ্য দিয়ে ট্রামলাইন, উভয় পাশে নানা পণ্যের বড় বড় দোকান, সুপার মার্কেট।

শহীদ হোসেন ৪৭ বছর আগের কথা বলতে শুরু করলেন। বহু বছর পর তিনি তাঁর স্মৃতিবিজড়িত এ শহরে এসেছেন। বললেন, গবেষণাকাজে ড. ওয়াজেদ মিয়া ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে এ শহরে আসার অল্প দিন পরেই তাঁর সঙ্গে ভালো সখ্য গড়ে ওঠে। বিকেলের দিকে প্রায়ই তাঁরা এ সড়ক ধরে হাঁটতেন। তিনি একটি সাইকেলের দোকানের সামনে থামলেন, দোকানর নাম রাড স্পোর্টস। বললেন, এই দোকান থেকে ওয়াজেদ ভাই তাঁর ছোট শ্যালক রাসেলের জন্য একটি ছোট সাইকেল কিনেছিলেন। আরও খানিকটা সামনে গিয়ে আরও একটি দোকান দেখালেন। পুরোনো একটি ভবনের নিচে টাবাকোসে বার্টেল নামের এই অভিজাত দোকানে চুরুটের পাইপ বিক্রয় হয়। ওয়াজেদ মিয়া বলতেন, উনি তাঁর শ্বশুর বঙ্গবন্ধুর জন্য একটি ভালো পাইপ কিনতে চান।

এভাবে পুরোনো দিনের নানা স্মৃতিকথা শুনতে শুনতে আমরা রাস্তার ধারে কফি শপে বসি। বলবীর গোয়েল বললেন, মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। ওয়াজেদ মিয়া কার্লসরুয়ের পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্রে এলেন। অল্প দিনেই তাঁদের মধ্যে ভালো সখ্য গড়ে উঠেছিল। সাপ্তাহিক ছুটিতে মাঝেমধ্যে তাঁদের বাড়িতে আসতেন। লম্বা সময় ধরে উপমহাদেশের রাজনীতি ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতেন। একদিন গবেষণাকেন্দ্রে জানালেন, বঙ্গবন্ধুকন্যারা এখানে আসবেন। আরও জিজ্ঞাসা করছিলেন, আশপাশে কোথায় দর্শনীয় কিছু জায়গায় বেড়ানো যায়? আমি তাঁকে বলেছিলাম বঙ্গবন্ধুকন্যারা এসে পৌঁছালে একদিন আমাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে।

এরপর আমরা এই প্রাচীন শহরের অন্যতম দ্রষ্টব্য কার্ল ভিলহেলম প্রাসাদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। পথে একটি বড় সড়ক পার হওয়ার প্রাক্কালে বলবীর গোয়েল আমাকে থামান। বললেন, রাস্তাটির নাম ক্রিগার স্ট্রাসে বা যুদ্ধ সড়ক। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যুদ্ধবাজ নেপোলিয়ান বোনাপার্ট এ সড়ক দিয়েই তাঁর সেনাবাহিনীকে মধ্য ইউরোপের দেশগুলো দখল করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন। কার্লসরুয়ে শহরে পশ্চিমে বহমান রাইন নদীর অনতিদূরেই ফ্রান্সের সীমান্ত।

একটু পরেই আমরা কার্ল ভিলহেলম প্রাসাদসংলগ্ন বিশাল পার্কে ঢুকি। দূর থেকেই ১৭১৫ সালে বারোক শৈলীতে তৈরি কার্লসরুয়ে প্রাসাদটি দেখা যায়। শহীদ হোসেন বললেন, ‘এই পার্কে আমি আর ওয়াজেদ ভাই অনেকবার ঘুরতে এসেছি। হাসিনা আপারা ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে কার্লসরুয়ে এসে পৌঁছালে তাঁদের সহযোগে বেশ খানিকটা সময় আমরা এখানে কাটিয়েছিলাম। প্রাসাদের ডান পাশে গেলেই এনগেসার স্ট্রাসে।’

কার্লসরুয়ে শহরের কেন্দ্র লেখকের সঙ্গে শহীদ হোসেন ও বলবীর গোয়েল

এই এনগেসার সড়কের ৩ নম্বর বাড়িটিই হলো লেকচার অতিথি ভবন। কার্লসরুয়ে ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ক্যাম্পাসেই ভবনটি অবস্থিত। এ ভবনের দ্বিতীয় তলাতেই ছিল ওয়াজেদ মিয়ার অ্যাপার্টমেন্ট। চারদিকে লম্বা লম্বা গাছ অতিথি ভবনটিকে যেন ঘিরে রেখেছে। অতিথি ভবনে ঢোকার আগে ছাদঢাকা লম্বা করিডর। কাচের বড় গেট দিয়ে সামনের কিছুটা দৃশ্যগোচর হয়। দরজার ডান পাশে অতিথি ভবনের বাসিন্দাদের নেমপ্লেট। লেকচার অতিথি ভবনের সামনে গিয়ে শহীদ হোসেন কাচের বন্ধ দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলেন। তারপর নেমপ্লেটে বাসিন্দাদের নাম পড়তে লাগলেন। আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনি কী খুঁজছেন?’ বললেন, ‘এই জায়গায় ওয়াজেদ ভাইয়ের নাম লেখা ছিল।’

এরপর আমরা লেকচার ভবনটির পশ্চিম দিকে যাই। শহীদ হোসেন বললেন, ‘ওই অ্যাপার্টমেন্টে হাসিনা আপারা ছিলেন। দুঃখের সেই দিনগুলোয় ওই অ্যাপার্টমেন্টে শেখ রেহানা ডুকরে ডুকরে কাঁদতেন। ডান দিকের ওই ঘর ছিল রান্নাঘর, হাসিনা আপা আগের রাতের ভাতগুলো নিয়ে সকালে নাশতার জন্য পেঁয়াজ–মরিচ দিয়ে ভাজতেন। মাঝেমধ্যে বাজার করে এনে আমিও সবার জন্য রান্না করতাম।’ আবার বলতে থাকলেন, ‘দিল্লি যাওয়ার দুই দিন আগে রেহানা আমার কাছে একটি মিনল্টা ক্যামেরা রেখে যান। ওয়াজেদ ভাই অনেক কাগজপত্রভর্তি একটি পলিথিনের থলে আমার হাতে দিয়ে রেখে দিতে বলেন। বহু বছর পর সেই থলের কাগজপত্রের মধ্য আমি শেখ রেহানার বিচ্ছিন্ন কিছু কথা লেখা তিনটি কাগজ খুঁজে পাই।’

কার্ল ভিলহেলম প্রাসাদসংলগ্ন পার্কে লেখকের সঙ্গে শহীদ হোসেন ও বলবীর গোয়েল

আমরা আবার লেকচার অতিথি ভবনের সামনে আসি। মূল গেটের পূর্ব দিকে গাড়ি পার্ক করার স্থান। বলবীর গোয়েল বলেন, ‘আমি ওই সময় একদিন এখানে এসেছিলাম, ওয়াজেদ মিয়ার অনুরোধে ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট দিল্লি রওনা হওয়ার দুই দিন আগে। আমার গাড়িটি এখানেই পার্ক করে আমি কলবেলে চাপ দিয়েছিলাম। উনি দরজা না খুলে দোতলা থেকে নিচে নেমে এসে আমাকে ওপরে নিয়ে যান। আমি সাহস করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনার স্ত্রী আর তাঁর ছোট বোন কেমন আছেন! জানালেন, তাঁরা কাঁদতে কাঁদতে এখন কেমন যেন চুপচাপ হয়ে পড়েছেন।’ এরপর আমরা বই ও কাগজপত্রভর্তি স্টিলের একটি ভারী ট্রাঙ্ক আমার গাড়ির বনেটে রাখি। বললেন, শিগগিরই অন্য কোথাও চলে যাবেন, তাই ট্রাঙ্কটি আমার কাছে রেখে দিতে চান।

এরপর আমরা এনগেসার সড়ক থেকে ডুরলাশার স্কয়ারের দিকে যাই। এখানে অবস্থিত কার্লসরুয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণবিষয়ক গোয়েন্দা পুলিশের দপ্তরটি আমাকে দেখান শহীদ হোসেন। ভয় আর আতঙ্কে নিজেদের একটু নিরাপত্তার জন্য ১৮ আগস্ট শহীদ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে ওয়াজেদ মিয়া এই দপ্তরে পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
অনেক পথ হেঁটে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বলবীর গোয়েল ও শহীদ হোসেন ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু দুই কন্যার জার্মানি ছেড়ে চলে যাওয়ার দিনের ঘটনা বলতে থাকেন। শহীদ হোসেন বলেন, ‘আমাকে ওয়াজেদ ভাই আগের রাতে বলেছিলেন, আগামীকাল ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে যেতে হতে পারে।’ কিন্তু তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন, শহীদ হোসেনকে তাঁরা বলেননি। আর বলবীর গোয়েল বলেন, সেই সময় বনে ভারতীয় দূতাবাসের প্রথম সচিব তাঁর পূর্বপরিচিত অরুণ পাটবর্ধন তাঁকে ওই দিন সকালে কার্লসরুয়ে স্টেশনে আসতে বলেন। স্টেশনে পৌঁছে ওয়াজেদ মিয়ার পরিবার, শহীদ হোসেন ও পাটবর্ধনের দেখা পান। বলবীর গোয়েলকে একটু সহযোগিতার কথা বলে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য শরিক হতে বলেন পাটবর্ধন। আর আমি শহীদ হোসেনকে চিনি কি না, তা জিজ্ঞাসা করেন।

কার্লসরুয়ে রেলস্টেশন, যেখান থেকে দিল্লি অভিমুখে যাত্রা শুরু হয়েছিল

ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে ওয়াজেদ মিয়ার পরিবার ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভেতরে চলে যান। অনেকটা সময় ধরে আমরা বাইরে অপেক্ষা করতে থাকি। হঠাৎ অরুণ পাটবর্ধন আমার কাছে এসে নিচু স্বরে বলেন, ‘আমার সঙ্গে ভেতরে আসুন।’ আমি তাঁর সঙ্গে ইমিগ্রেশনের সামনে আসি। উনি একজন অফিসারকে একটি কাগজ বের করে দেখান। তারপর খানিকটা হেঁটে এয়ার ইন্ডিয়ার দিল্লিগামী প্লেনের ভেতরে ঢুকি। ওয়াজেদ মিয়া চোখের ইশারায় আমাকে সম্ভাষণ জানান। দেখি, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা করুন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি নেমে যাওয়ার কিছু পরেই প্লেন উড়ে যায়।
আমরা আস্তে আস্তে কার্লসরুয়ে রেলস্টেশনের সামনের হোটেলে এসে পৌঁছাই। শহীদ হোসেন তাঁর স্মার্ট ঘড়ি দেখে বললেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই সাড়ে সাত কিলোমিটার হেঁটেছি।’ ১৯৭৫ সালের দুঃসময়ের সেই দুই সাক্ষীর সঙ্গে কথোপকথন আমার হাঁটার ক্লান্তি চলে যায়।


সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি।