বজ্রপাতে মে মাসে তিন বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যু

দুর্যোগবিষয়ক সংস্থা ডিজাস্টার ফোরামের হিসাবে এ বছরের মে মাসে যে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ২০ জনই কৃষক।

বজ্রপাতপ্রতীকী ছবি

চলতি বছরের মে মাসে দেশে বজ্রপাতে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আগের দুই বছরে এ মাসে বজ্রপাতে এত মৃত্যু হয়নি। গত সাত বছরের মে মাসে এ সংখ্যা তৃতীয় সর্বোচ্চ।

দেশে এ বছর (১০ জুন পর্যন্ত) ১২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে এ দুর্যোগে। বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা সাধারণত নভেম্বর মাস পর্যন্ত ঘটে। গত বছর মৃত্যু হয়েছিল ২৮০ জনের। মে মাস ছাড়াও এখন জুন মাসে মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ছে। দেখা গেছে, বজ্রপাতে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে কৃষকের সংখ্যাই বেশি।

বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে সরকারি নানা উদ্যোগ আছে। এরই মধ্যে একে দুর্যোগও ঘোষণা করা হয়েছে। তারপরও মৃত্যু কমছে না। ভুল প্রকল্প, বড় গাছ কাটা বন্ধ না হওয়া এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতা তৈরির চেষ্টা না থাকায় মৃত্যু রোধ হচ্ছে না—বিশেষজ্ঞরা এমনটাই মনে করেন।

দেশের বজ্রপাত পরিস্থিতি এবং এতে হতাহতের ঘটনা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরাম। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে, ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে প্রাণ গেছে ৩ হাজার ৮৭০ জনের। অর্থাৎ প্রতিবছর ২৭৬ জনের বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন ২০২১ সালে, ৩৮১ জন। ওই বছরের মে মাসে বজ্রপাতে সর্বোচ্চ ১২০ জনের মৃত্যু হয়।

এর আগে মে মাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় ১৫৮ জনের, ২০১৮ সালে। দেশে কোনো একটি মাসে বজ্রপাতে এত মৃত্যুর ঘটনা আর ঘটেনি। গত বছরের মে মাসে (২০২৩) ৬৮ জন এবং এর আগের বছর (২০২২) মে মাসে ৫৭ জনের মৃত্যু হয়।

খোলা প্রান্তরে বড় গাছ কেটে উজাড় করে ফেলা এবং নতুন কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা না রাখার কারণেই দিন দিন বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ আবদুল লতিফ খান। তিনি বলেন, ‘আমরা পুরোনো গাছ রক্ষা করছি না। গাছ উজাড় হলেও এর বিরুদ্ধে কোনো তৎপরতা নেই। তাহলে সুরক্ষাটা থাকবে কোথায়?’

মে মাসে এত মৃত্যু কেন

দ্য অ্যাটমোস্ফিয়ার সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘রিসেন্ট ক্লাইমেটোলজি অব থান্ডারস্টর্ম ডেজ ওভার বাংলাদেশ’ নামের গবেষণায় বাংলাদেশে বজ্রঝড়ের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। এতে ১৯৮১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের বজ্রঝড়ের উপাত্ত তুলে ধরে বলা হয়েছে, এ সময়ে দেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রঝড় হয়েছে মে মাসে। এর গড় সংখ্যা ১৩। এরপরই আছে জুন মাস, সংখ্যা ১২। বজ্রঝড় নভেম্বর পর্যন্ত থাকছে।

এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, উষ্ণতা বাড়ছে। গ্রীষ্মকালে শুধু নয়, উষ্ণতার পরিধি বর্ষার সময়েও বিস্তৃত হচ্ছে। মে মাসে বজ্রঝড়ের সংখ্যা বাড়ছে। বজ্রঝড়ের সঙ্গে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বজ্রপাত ঘটে।

দেখা গেছে, সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে বজ্রঝড়ের বার্ষিক দিনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ সংখ্যা যথাক্রমে ১৩৬ ও ১১৬।

মে মাসে বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে আর্থসামাজিক দু-একটি বিষয়ের সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক। তিনি বলছিলেন, বজ্রপাতে মৃতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ কৃষক। আবার বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনাও বেশি ঘটে হাওর এলাকায়। এপ্রিল ও মে মাস সাধারণত ধান কাটার মৌসুম। প্রায় বৃক্ষহীন খোলা প্রান্তরে কৃষক ধান কাটার কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন।

ডিজাস্টার ফোরামের ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত হিসাবে দেখা গেছে, এ সময় ১৩৫ জনের মৃত্যু হয়। জেলার হিসাবে সবচেয়ে বেশি ১১ জন সুনামগঞ্জ জেলায় মারা গিয়েছিল সে সময়। আর এপ্রিল মাসে ৩১ জন ও মে মাসে ৩২ জন কৃষক বজ্রপাতে মারা যান। দেখা গেছে, এ বছরের মে মাসে যে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের ২০ জনই কৃষক।

প্রকল্পে রোধ হচ্ছে না প্রাণহানি

বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে সরকার একে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এরপর বজ্রপাতে মৃত্যু রোধে একাধিক প্রকল্পও নেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি ছিল তালগাছ লাগানো। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ওই প্রকল্পে ৪০ লাখ তালগাছ লাগানোর কথা থাকলেও তা ব্যর্থ হয়। ২০১৮ সালে আবহাওয়া অধিদপ্তর ৬২ কোটি টাকার বজ্রপাত সংকেত যন্ত্র ‘লাইটেনিং ডিটেকশন সেন্সর’ প্রকল্প নেয়। পরে সেন্সরগুলো নষ্ট হয়ে যায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এবার ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়ে আসছে। এর আওতায় বসানো হবে বজ্রনিরোধক দণ্ড (লাইটেনিং অ্যারেস্টার), যা বজ্রপাত থেকে স্থানীয় মানুষকে সুরক্ষা দেবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তা হয়তো পর্যাপ্ত নয়। আমাদের নতুন কোনো ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসলে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া এবং তাতে অর্থের অপচয় হলেও বজ্রপাতে মৃত্যু কমেনি। বজ্রপাতে মৃত্যু রোধে নতুন উপায় অনুসন্ধানে গবেষণাও নেই।

বজ্রপাত নিরোধে বজ্রঝড়ের সময় রাবারের স্লিপার পরে সুরক্ষা পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে নেপালে এমন চর্চা শুরু হয়েছে। এ কথা তুলে ধরে দুর্যোগবিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ‘এত মৃত্যুর পর আমাদের দেশে কার্যকর কোনো গবেষণা নেই। অর্থের অপচয় হয়, এমন প্রকল্পেই আগ্রহ বেশি।’