ভারতে গণতন্ত্রের চর্চা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য প্রেরণার 

এম হুমায়ুন কবীর

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক আছে। বিজেপির জন্য ইতিবাচক ঘটনা যে দলটি তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার মতো অবস্থানে রয়েছে। আবার কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোট বেশ ভালো ফল করেছে। অনেক জায়গায় তারা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে বিজেপিকে। ২০১৪ সালের পর এক শর কাছাকাছি আসনে জিতে কংগ্রেস উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। 

আসলে এবারের নির্বাচনে জিতেছে ভারতের জনগণ, যা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এবারের নির্বাচনের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে বেশ কিছু দিক সামনে আসে। নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, সক্ষমতা ও কার্যকারিতা নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল। নির্বাচন কমিশন আদৌ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারবে কি না-এমন সন্দেহও দানা বেঁধেছিল।

ভারতের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক যেখানে পৌঁছেছিল, সেটাও আলোচনার দাবি রাখে। বিরোধী নেতাকে সংসদ থেকে বের করে দেওয়া, জেলে পাঠিয়ে দেওয়া-এসব ভারতের রাজনীতিতে যোগ করেছিল নতুন মাত্রা। সরকারের সঙ্গে এমন নেতিবাচক সম্পর্কের সমীকরণ ভারতের রাজনীতিতে বিরলই বলা চলে। এসব ঘটনা জনমনে একধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ফেলেছিল।

এবারের নির্বাচন ছিল নরেন্দ্র মোদির, বিজেপির নয়। আসলে পুরো নির্বাচন হয়েছে মোদির বাতাবরণে। এই বাতাবরণে গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল কিংবা সরকারের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে এই অভিযোগকে সমর্থন করে বুথফেরত জরিপের ফলাফল। মোদি তৃতীয়বার নিরঙ্কুশ জয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাবেন বলে গণমাধ্যমে বলা হয়েছিল; যা প্রকারান্তরে বিরোধীদের জন্য মানসিক প্রতিকূলতা তৈরি করেছিল। কিন্তু ভারতের জনগণ শেষ পর্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। বিজেপি শুধু এক ব্যক্তির ওপর ভর করে নিরঙ্কুশ বিজয় চেয়েছিল। জনগণ এমন ধারণার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছে। দলটি তেমন জয় পায়নি। 

এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে বিজেপি জোট সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে ভারতের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন স্পষ্ট হয়েছে নির্বাচনের ফলাফলে। এই নির্বাচনে আশির দশকের মতো আঞ্চলিক দলগুলোর উত্থান হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে একধরনের কোণঠাসা অবস্থায় নিয়ে গেছে তৃণমূল কংগ্রেস। উত্তর প্রদেশে অভাবিতভাবে বিজেপিকে হারিয়ে সমাজবাদী দল জিতেছে। রাজস্থান আর তামিলনাড়ুতেও আঞ্চলিক দলগুলো ভালো করেছে। ফলে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক দলগুলো বড় ভূমিকায় আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। 

বিজেপি তাদের দুই শরিক অন্ধ্র প্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডু ও বিহারের নীতীশ কুমারের সঙ্গে আলোচনায় রয়েছে। পাশাপাশি কংগ্রেসও তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। অর্থাৎ সরকার গঠনে আঞ্চলিক দলগুলোর ওপর নির্ভরতা থাকবে। বিজেপির নিরঙ্কুশ ক্ষমতার ব্যবহার সীমিত হয়ে পড়বে। ইন্ডিয়া জোট এই দলগুলোসহ ছোট দল নিয়ে সরকার গঠনের চেষ্টা করতে পারে। ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনায় বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে সরকার পরিচালনা করতে হবে। 

ভারতের নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনবে না। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়েছে। আর ২০১৪ সাল থেকে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর সেই ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে। ফলে ভারতে ক্ষমতায় যে-ই আসুক না কেন, তাতে দুই দেশের সম্পর্কের মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে না। 

নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভারতের যে রাজনৈতিক বিন্যাস হয়েছে, তাতে কোনো পক্ষ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন করার মতো সক্ষমতা রাখবে না। বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ ক্ষমতায় আসার পর যে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করার কথা ভেবেছিল, চাইলেই তারা তা করতে পারবে না। বিরোধী দলের প্রতিরোধের মুখে তাদের পড়তে হবে। 

এবারের নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপ থেকে বিজেপির পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য এসেছিল। জনগণ যে তা প্রত্যাখ্যান করেছে, উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় বিজেপির পরাজয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই উত্তর প্রদেশেই বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছে। রামমন্দির নির্মিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের বেশি চর্চাও হয়েছে সেখানেই। উত্তর প্রদেশের জনগণ সাম্প্রদায়িক এসব বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে। দীর্ঘ মেয়াদে এটি ভারতের ও পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ইতিবাচক জায়গা তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। 

সামগ্রিকভাবে বলা যায়, ভারতে গণতন্ত্রের চর্চা বলিষ্ঠ হলে তা দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্য প্রেরণাদায়ক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।