ট্রেড লাইসেন্স বাতিল, রেস্তোরাঁগুলো কি এখন বন্ধ হয়ে যাবে

রেস্তোরাঁপ্রথম আলো ফাইল ছবি

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) যেসব ভবনের নকশায় রেস্তোরাঁ নেই, সেই সব ভবনে থাকা রেস্তোরাঁর ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করেছে।

সোমবার এ বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারির পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখন শত শত রেস্তোরাঁ সংকটে পড়েছে। মালিকেরা বুঝতে পারছেন না, এখন কী হবে।

জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেড লাইসেন্স বাতিলের পর এখন তাঁরা এসব রেস্তোরাঁ বন্ধ করার উদ্যোগ নেবেন। এ জন্য ব্যবসায়ীদের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সময়সীমা ঠিক করে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তাঁরা চিন্তাভাবনা করবেন।

সাধারণ রেস্তোরাঁমালিকেরা বলছেন, বৈধভাবে রেস্তোরাঁ করা অত্যন্ত কঠিন করে রেখেছে সরকার। এ কারণেই বেশির ভাগ রেস্তোরাঁ এত সব অনুমোদন দিতে পারে না। এর সুযোগ নেন অসাধু কর্মকর্তারা।
প্রতীকী ছবি

দ্য মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন (ট্যাক্সসেশন) রুলস, ১৯৮৬ অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন এলাকায় যেকোনো ধরনের ব্যবসা করতে হলে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১ হাজার ২৬টি রেস্তোরাঁ ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে।

সমস্যা হলো, যেসব ভবনে রেস্তোরাঁ করা হয়, সেসব ভবনের নকশায় রেস্তোরাঁ থাকে না। আবার অনেক সময় রেস্তোরাঁ ট্রেড লাইসেন্স নেয় না।

আরও পড়ুন

দক্ষিণ সিটির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে সিটি করপোরেশনকে ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।

ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করে এখন যদি ডিএসসিসি অভিযানে নামে, তাহলে নতুন করে হয়রানিতে পড়বেন ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতি হলে আমাদের রেস্তোরাঁ বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।’
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান

ট্রেড লাইসেন্স বাতিলের পর করপোরেশন কী করবে, জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা নিয়ে আলাপ–আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পাশাপাশি দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় কতগুলো রেস্তোরাঁ আছে, তা হিসাব করার চিন্তা চলছে।

বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইন অনুযায়ী, রেস্তোরাঁ ব্যবসা করতে চাইলে একজন বিনিয়োগকারীকে সরকারের সাতটি সংস্থার অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিতে হয়। প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রসহ নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে প্রথমে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয় থেকে রেস্তোরাঁ ব্যবসা করার জন্য নিবন্ধন (অনুমতি) নিতে হয়। এই নিবন্ধন পাওয়ার পর ডিসির কার্যালয় থেকেই রেস্তোরাঁ ব্যবসার লাইসেন্স (সনদ) নিতে হয়। আইন অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাইয়ের পর এক বছরের মধ্যেই ডিসির কার্যালয় লাইসেন্স দেবে নিবন্ধন পাওয়া রেস্তোরাঁকে।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পাশাপাশি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন ও সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিতে হয় একজন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীকে। এর বাইরে দই ও বোরহানির মতো বোতল বা প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্য কোনো রেস্তোরাঁ বিক্রি করলে বিএসটিআইয়ের (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) অনুমোদন নিতে হয়।

রাজধানীতে অনিয়মের মাধ্যমে ভবন, রেস্তোরাঁ, রাসায়নিক ব্যবসাসহ নানা কিছু গড়ে উঠতে দেয় সরকারি সংস্থাগুলো। খাতগুলো বড় হয়, মানুষ বিনিয়োগ করে, তরুণদের কর্মসংস্থান হয়, তারপর একসময় সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকারি সংস্থাগুলো।
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডের সেই দৃশ্য
ফাইল ছবি

জেলা প্রশাসনের তথ্যের বরাত দিয়ে গত বছর ২৭ মার্চ প্রকাশিত প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ঢাকায় বৈধ রেস্তোরাঁ আছে মাত্র ১৩৪টি।

ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কারওয়ান বাজারের ‘রেস্টুরেন্ট লা ভিঞ্চি’ ২০০১ সালে প্রথম লাইসেন্স নিয়ে রাজধানীতে রেস্তোরাঁ ব্যবসা শুরু করে। এরপর ২০০৩ সালে কারওয়ান বাজার ও ঠাঁটারীবাজার শাখার জন্য লাইসেন্স নেয় হোটেল সুপার স্টার রেস্টুরেন্ট লিমিটেড। একই বছর আরও তিনটি প্রতিষ্ঠান রেস্তোরাঁ ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নেয়। ট্রান্সকম ফুডস লিমিটেডের কেএফসি এবং পিৎজাহাটের শাখাগুলোও লাইসেন্স ও নিবন্ধন নিয়ে ব্যবসা করছে।

সাধারণ রেস্তোরাঁমালিকেরা বলছেন, বৈধভাবে রেস্তোরাঁ করা অত্যন্ত কঠিন করে রেখেছে সরকার। এ কারণেই বেশির ভাগ রেস্তোরাঁ এত সব অনুমোদন দিতে পারে না। এর সুযোগ নেন অসাধু কর্মকর্তারা।

লাইসেন্স ছাড়া রেস্তোরাঁ ব্যবসা করার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে গত বছর ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামের একটি ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর। আটতলা ওই ভবনে আগুনে নিহত হন ৪৬ জন। ভবনে ৮টি রেস্তোরাঁ ছিল। যদিও ভবনটিতে রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠার কোনো অনুমোদন ছিল না।

ওই অগ্নিকাণ্ডের পর গত বছর ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় রেস্তোরাঁর নিবন্ধন ও লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া কীভাবে আরও সহজ করা যায়, সে বিষয়ে সুপারিশ করতে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। যদিও কাজ খুব একটা এগোয়নি।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকের পাস করা ভবনের নকশায় রেস্তোরাঁ নেই বললেই চলে। বিগত সরকারের সময় এই জটিলতা নিরসনে একটা টাস্কফোর্স করা হয়েছিল। সেই টাস্কফোর্সের দুটি বৈঠক হয়েছিল। তারপর তো সরকার বদল হয়ে গেল।

ইমরান আরও বলেন, ‘ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করে এখন যদি ডিএসসিসি অভিযানে নামে, তাহলে নতুন করে হয়রানিতে পড়বেন ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতি হলে আমাদের রেস্তোরাঁ বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।’

রাজধানীতে অনিয়মের মাধ্যমে ভবন, রেস্তোরাঁ, রাসায়নিক ব্যবসাসহ নানা কিছু গড়ে উঠতে দেয় সরকারি সংস্থাগুলো। খাতগুলো বড় হয়, মানুষ বিনিয়োগ করে, তরুণদের কর্মসংস্থান হয়, তারপর একসময় সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকারি সংস্থাগুলো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তরুণ এক রেস্তোরাঁমালিক প্রথম আলোকে বলেন, যৌক্তিক সমাধানের বদলে সরকারি সংস্থাগুলো দায় এড়ানো অথবা দায়সারা কাজ করে। অনেক সময় তাদের নিয়মনীতিতে কঠোর হওয়ার পেছনে থাকে অবৈধ সুবিধা আদায়। তিনি বলেন, সমস্যার সত্যিকার সমাধানে দরকার গঠনমূলক উদ্যোগ।