ইতিহাস থেকে দেশের স্বপ্নে

িনাজপুর এলাকায় একটি অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। ছবিটি মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকের। কলকাতার সেন্টার ফর সোশ্যাল সায়েন্স স্টাডিজ থেকে সংগৃহীত
ছবি: অমিয় তরফদার

আর ৫০ বছর পরে বাংলাদেশে এমন একজন মানুষকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি একাত্তরের ২৬ মার্চের সাক্ষী ছিলেন। কোনো চাক্ষুষ সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে তাহলে কীভাবে দেখা হবে দিনটিকে, কীভাবে পড়া হবে এর ইতিহাস, এটি নিশ্চয় অনুমানের বিষয়। কিন্তু ইতিহাস নিয়ে প্রচলিত কিছু চিন্তার আলোকে এখনই হয়তো বলা যায়, দিনটিকে ছোট-বড় নানা রাজনৈতিক দল পড়বে তাদের আদর্শগত অবস্থান থেকে; সেদিন যারা এক ঘৃণিত, পরিকল্পিত গণহত্যার সূচনা করেছিল, তাদের উত্তরসূরিরা পড়বে আরেকভাবে এবং তাদের এই পড়ার সঙ্গে হয়তো একমত হবে যারা একাত্তরজুড়ে তাদের সহযোগী ছিল, তাদের ভাবাদর্শধারীরা।

আবার অনেকে দিনটিকে পড়বে এক অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতার এবং একই সঙ্গে অভাবনীয় মহিমার দিন হিসেবে। এদের সংখ্যা নিশ্চয় ক্ষুদ্র করে দেবে বাকিদের যোগফলকে। কারণ, দিনটি যে ছিল একটি জাতির নতুন জন্মের, তার আত্মপ্রত্যয় আর সাহসের, তার মৃত্যুকে হার মানানো জীবনীশক্তির শ্রেষ্ঠ প্রকাশের, এ সত্যটিই তারা উদ্ভাসিত হতে দেখবে ওই মহিমার দ্যুতিতে।

৫০ বছরে বাংলাদেশের অবস্থান নিশ্চয় অনেক মজবুত হবে, বিশ্বসভায় এর আসনটা হবে সম্মানের। একাত্তরে দেশটি নিয়ে পরিহাস করতেন পশ্চিমের কিছু বিশ্বমোড়ল, যার প্রভাবে এত বড় একটা গণহত্যা কোনো আঁচড়ই ফেলতে পারল না পশ্চিমের বিবেকে, এখন সেই পরিহাস আর নেই, তবে ভুল স্বীকারের উদ্যোগও নেই। তাতে অবশ্য আমাদের কিছু যায় আসে না। ওই পশ্চিমই তো এখন মহামারি আর অর্থহীন এক যুদ্ধে বিপর্যস্ত, এর কোনো কোনো দেশের অর্থনীতি যাচ্ছে ঝুড়ির তলার দিকে।

আপাতত বিশ্বের প্রসঙ্গটি বাদ দিয়ে, ভবিষ্যৎকে সময়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে বর্তমানে ফিরে আসা যাক এবং ইতিহাস নিয়ে প্রচলিত দু–এককটি চিন্তা নিয়ে কথা বলা যাক। স্কুলে ইতিহাস বইতে পড়েছি, যেসব পদ্ধতি ইতিহাসে সক্রিয়, অর্থাৎ যেগুলোর প্রভাবে ইতিহাস নির্মিত হয়, মানুষ সেগুলো পরিবর্তন করতে পারে না। ইতিহাসের স্যার বলতেন, ইতিহাস লেখা হয় রাজা-বাদশাহদের নিয়ে, ইতিহাস সাধারণ মানুষজনকে স্বীকার করে না। এই এত বছর পর এগুলো নিয়ে ভিন্ন কথা বলা যায়। দাবি করা যায়, ইতিহাসের নিজস্ব বা নিরপেক্ষ পদ্ধতি বলে কিছু নেই। ইতিহাসের নির্মাতা মানুষ, ফলে মানুষ ইতিহাস বদলাতে পারে। অথবা সাধারণ মানুষের ইতিহাসটা রাজা-বাদশাহদের ইতিহাসের আড়ালে চলে গেলেও হারিয়ে যায় না। এই ইতিহাস থাকে তার অসংখ্য চিহ্ন নিয়ে, স্মৃতিতে, সময়ের করতলে। তাকে খুঁজে নিতে হয়।

১৯৭১ সালে ইতিহাসটাই পাল্টে দিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। এ জন্য এই ইতিহাস পৃথিবীর উচ্চবর্গের দেশের উচ্চবর্গের নেতাদের অস্বস্তিতে ফেলেছিল, যেমন ১৯৪৭ সাল থেকে বাংলাদেশের ২৪ বছরের ইতিহাস অস্বস্তিতে ফেলেছিল পাকিস্তানের উচ্চবর্গ সামরিক-শিল্পপতি-ভূমিমালিক বর্গকে। ১৯৭১–এর মার্চজুড়ে, এর পরের প্রতিটি মাসজুড়ে ইতিহাস প্রত্যক্ষ করেছে গণমানুষের অভ্যুত্থান। এক জনযুদ্ধ একত্র করেছিল সারা দেশের মানুষকে এবং এর ‘সাধারণ মানুষজন’ যদি যুদ্ধে না নামত বাংলাদেশের জন্মই হতো না। এই সাধারণ মানুষজন থেকেই এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা, এঁরাই একাত্তরে সারা গ্রামে তাঁদের দরজা খুলে দিয়েছিলেন শহর থেকে পালিয়ে আসা মানুষজনের জন্য। যে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন একাত্তরে, তাঁদের সিংহভাগ ছিলেন তাঁরাই। তাঁদের মাতা-স্ত্রী-কন্যারা তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন, অনেকে হারিয়েছেন প্রাণও।

প্রতিবছর ২৬ মার্চ আসবে, স্বাধীনতার দিনটি আমরা উদ্‌যাপন করব, শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিলিয়ে দেওয়া মানুষদের কথা স্মরণ করব। কিন্তু রাজনীতি, ক্ষমতা, নানা স্বার্থচিন্তা আর মতাদর্শগত অবস্থান আমাদের যতই বিভাজিত করুক, আমরা যেন ইতিহাসটাকে সঠিকভাবে পড়ি। আর সেই ইতিহাসে যেমন থাকবেন বঙ্গবন্ধুসহ ১৯৪৭ থেকে নিয়ে একাত্তরের নায়কেরা, তেমনি থাকবেন চোখের আড়ালে চলে যাওয়া সাধারণ মানুষেরা। ২৬ মার্চের ভোর এসেছিল এক ঘোর অমানিশার পর। সেদিন এক নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। যদি এই বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের অহংকার থাকে, স্বপ্ন থাকে, তবে এর ইতিহাসটাও যেন আমরা সঠিকভাবে পড়ি।

সঠিক পড়াটা কোনো মতাদর্শের, স্বার্থ ও গোষ্ঠীচিন্তার চশমা দিয়ে হয় না, এর চশমাটা আমাদের দিয়ে গেছেন একাত্তরের শহীদেরা। সেটা রক্ষা করে চলছেন এই দেশের সাধারণ মানুষ।