তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনতে আপিল করা হবে: বদিউল আলম মজুমদার
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনতে আপিল করা হবে।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের কথা তুলে ধরে এ কথাগুলো জানান বদিউল আলম মজুমদার। এ সময় আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া ও রিয়াদুল করিম উপস্থিত ছিলেন।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়েছে। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরলেও ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়টি আপিল বিভাগের মাধ্যমেও বাতিল করার ফলে এখনো পুরোপুরি ফিরতে পারেনি। তাই এ বিষয়ে আপিল করা হবে।
বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনী অবৈধ ছিল। ফলে এই সংশোধনের আলোকে যে সরকার গঠন হয়েছে সেটিও অবৈধ। তিনি বলেন, ‘রায় হয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট। এই রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসার পথ সুগম হলো। যদিও পঞ্চদশ সংশোধনী পুরোপুরি বাতিল করেনি, এটি আমরা পুরোপুরি বাতিলের দাবি জানিয়েছি। তবে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়ে আমরা আপিল করব।’
মামলার রায়ের বিষয়ে আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া বলেন, ‘গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর পঞ্চদশ সংশোধনী মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা হয়েছিল ৮ জুলাই। তবে আজ তার কপি আমরা হাতে পেলাম।’ তিনি বলেন, মামলার রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর অনেকগুলো খারাপ দিককে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে যে বাতিল করা হয়েছে, সেটিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পূর্বের জায়গায় কিছুটা ফিরে গেছে। আপিল বিভাগের মাধ্যমে সংশোধনী বাতিল করার ফলে এখনো পুরোপুরি ফিরতে পারেনি।
সংবিধান সংশোধনের জন্য যে নিয়ম মানা দরকার পঞ্চদশ সংশোধনীতে সেই নিয়ম মানা হয়নি বলে জানান আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, বেশির ভাগ মানুষের অগোচরে ২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধানের একটা পাইকারি পুনর্লিখন হয়ে গিয়েছিল। এই পঞ্চদশ সংশোধনী শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল না, এতে পুরোপুরি রাষ্ট্রকাঠামোকে পরিবর্তন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে নষ্ট করে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছিল পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। বিচারপতি খাইরুল হকের রায় পুরোপুরি বাতিল করার কথা বলেন এই আইনজীবী।
২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে করা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিল করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তবে পরে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে মত দেন আদালত। আর এ ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনে সংসদে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে বলেও জানিয়েছিলেন আদালত। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ রায় দেন।
আদালত রায়ে বলেন, আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতেই আবেদনটি গৃহীত হয়েছে। এর মাধ্যমে ‘সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধনী) আইন ১৯৯৬’ এই নির্দেশের পর থেকে অবৈধ ও সংবিধানবহির্ভূত ঘোষণা করা হলো। তবে আইনসম্মত না হলেও (প্রয়োজনের কারণে আইনসম্মত এবং জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন—সুপ্রাচীনকাল ধরে চলে আসা নীতিমালার ভিত্তিতে) আগামী দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল করা ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় হতে পারে।
এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতিদের মধ্য থেকে অথবা আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে একজনকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিধানটি বাতিল করার পূর্ণ স্বাধীনতাও সংসদের থাকবে। একই সঙ্গে ২০০৫ সালে এ প্রসঙ্গে দায়ের করা লিভ টু আপিলটিও খারিজ করা হলো বলে জানান আদালত।
২০১১ সালের ৬ এপ্রিল এ আপিলের ওপর শুনানি গ্রহণ শেষে বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন আপিল বিভাগ। রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মামলার অন্যতম পিটিশনার আবদুল মান্নান খান বলেছিলেন, ‘আপিল বিভাগের এই আদেশের ফলে দেশের গণতন্ত্রের ভিত আরও সুদৃঢ় হবে এবং বিচার বিভাগ আরও বেশি প্রভাবমুক্ত থাকতে পারবে।’
প্রসঙ্গত, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় ১৯৯৬ সালে। এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। ওই বছরের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগ এ রিট খারিজ করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করা হয়।
এরপর ২০০৫ সালে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আইনজীবী সলিম উল্লাহ। দীর্ঘ বিরতির পর গত ১ মার্চ শুনানি শুরু হয়। আদালত এই মামলায় আটজন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ করে তাঁদের মতামত শোনেন।
তাঁদের মধ্যে পাঁচজন সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে মত দিয়েছেন। তাঁরা হলেন ড. কামাল হোসেন, আইনজীবী টি এইচ খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম ও রোকনউদ্দিন মাহমুদ।
অপর অ্যামিকাস কিউরি আজমালুল হোসেন কিউসি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মত দেন। আইনজীবী রফিক-উল-হক ও এম জহির তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আমূল সংস্কারের পক্ষে মত দিয়ে তাঁদের প্রস্তাব আদালতে তুলে ধরেন। এ ছাড়া তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দেন।