বন কেটে ইয়ার্ড, বাতিল ইজারা ফিরে পেল কোহিনূর স্টিল

হাইকোর্টের আদেশে ইজারা বাতিলের পর অন্য নামে ইজারা চুক্তি। দ্বিতীয় ইজারাও বাতিল। শেষে বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে আপিলে পর চুক্তি পুনর্বহাল।

জাহাজভাঙা ইয়ার্ডটিতে গত বছরের ২৯ মে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়ফাইল ছবি

বনাঞ্চল কেটে গড়ে ওঠা বিতর্কিত সেই জাহাজভাঙা ইয়ার্ডের ইজারা পুনর্বহালের আদেশ দিয়েছে বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়। চুক্তির শর্ত ভঙ্গের অভিযোগে গত বছর জেলা প্রশাসন সীতাকুণ্ডের কোহিনূর স্টিল নামে ওই জাহাজভাঙা কারখানার ইজারা বাতিল করেছিল। উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করে হাইকোর্টে প্রতিবেদনও দিয়েছিল জেলা প্রশাসন।

আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বাতিল ইজারা ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয় চলতি মাসে। এর আগে বিভাগীয় কমিশনার বরাবর ইজারা চুক্তি বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল করেন কোহিনূর স্টিলের স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম ওরফে রাজা কাশেম। ইজারা ফিরে পেয়ে ইয়ার্ডে পুনরায় জোরেশোরে কাজ শুরু করা হয়েছে। সীতাকুণ্ডের সলিমপুর এলাকার তুলাতলী মৌজায় কোহিনূর স্টিল নামে ইয়ার্ডটির অবস্থান।

জানতে চাইলে বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাদের আপিল মঞ্জুর করা হয়েছে। মানে ইজারা পুনর্বহাল করা হয়েছে। তাই হয়তো তারা আবার সেখানে কাজ করেছে।

আদালতের নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘আমাদের অতিরিক্ত কমিশনার (রাজস্ব) ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই নিশ্চয় এ আদেশ দিয়েছেন।’

জানা গেছে, তুলাতলী মৌজা জাহাজভাঙা কারখানার অধিভুক্ত অঞ্চল নয়। ওখানে বন বিভাগের ২০ ধারায় নোটিফিকেশনকৃত বনাঞ্চল রয়েছে। ইজারা চুক্তিতে কাগজে-কলমে সলিমপুর মৌজা দেখানো হলেও মূলত তুলাতলী মৌজায় বিতর্কিত এই ইয়ার্ড গড়ে ওঠে। বন বিভাগ বারবার এই ইজারায় আপত্তি জানিয়ে আসছিল।

আপত্তি উপেক্ষা করে তখনকার জেলা প্রশাসকেরা একই ভূমি দুবার রাজা কাশেমকে ইজারা দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে প্রথম ৭ দশমিক ১০ একর ভূমি শিপইয়ার্ডের জন্য ইজারা পায় কাশেমের বিবিসি স্টিল। কিন্তু তুলাতলী মৌজাটি বনাঞ্চলঘেরা হওয়ায় উচ্চ আদালতের আদেশে তা বাতিল হয়ে যায়।

বিবিসির নামে ইজারা বাতিল হওয়ার পর কাশেম তাঁর স্ত্রী কোহিনূর আকতারের নামে নতুন করে একই জায়গায় জমি ইজারার আবেদন করেন। আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয় কোহিনূর স্টিল। এরপর ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কোহিনূর স্টিলের নামে সীতাকুণ্ডের উত্তর সলিমপুর মৌজা দেখিয়ে পাঁচ একর বনভূমি ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন।

এ নিয়ে ২০২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় ‘প্রথমে ব্যর্থ পরে “কৌশলে” ইজারা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আবার গত বছরের ৮ জুন ‘চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদারতায় ইয়ার্ডের পেটে ৫ হাজার গাছ’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

২০১৯ সালে প্রথম ইজারা দেওয়ার পর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) হাইকোর্টে এর বিরুদ্ধে মামলা করে। শুনানি শেষে হাইকোর্ট এই ইজারা বাতিল করে দেন। এরপর ২০২২ সালে দ্বিতীয় দফায় আবার ইজারা দেওয়া হয় একই ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানকে। এরপর বেলা বিষয়টি আদালতের নজরে আনে। একটি আদালত অবমাননার মামলাও হয়। সেই মামলায় সরকারের পক্ষ থেকে আদালতকে জানানো হয় যে জেলা প্রশাসন ইজারা বাতিল করেছে। গত বছরের ২৯ মে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করার অভিযোগ এনে ইজারাকৃত জায়গায় উচ্ছেদ কার্যক্রম চালায় জেলা প্রশাসন।

গত বছরের ১ জুন দ্বিতীয়বারের মতো ইজারা চুক্তি বাতিল করা হয়। জেলা প্রশাসনের ইজারা বাতিলের নথিতে উল্লেখ করা হয়, ‘ইজারাদার গাছপালা কেটে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন করেছেন। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পূর্ব অনুমতি ছাড়া চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার তুলাতলী, দক্ষিণ সলিমপুর, চর বাঁশবাড়িয়া এবং বোয়ালিয়া মৌজা অথবা সমুদ্র উপকূলবর্তী অন্য কোনো স্থানে জাহাজভাঙা ইয়ার্ড স্থাপন করা যাবে না। বর্ণিত ইজারাদার একসনা ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে শিল্পাঞ্চল-বহির্ভূত তুলাতলী মৌজায় ১ নম্বর খাস খতিয়ানের জমি অবৈধভাবে দখল করে দ্বিতল ভবন নির্মাণ করায় কোহিনূর স্টিলের একসনা ইজারা বাতিল করা হয়েছে।’

জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শর্ত ভঙ্গ করার কারণে কোহিনূর স্টিলের ইজারা চুক্তি বাতিল করেছিলাম। এরপর তারা বিভাগীয় কমিশনার স্যার বরাবর আপিল করে। আপিল মঞ্জুর হয়েছে কি না, আমার জানা নেই।’

বন বিভাগের অভিযোগ, দু-দুবার ইজারা নিয়ে তারা সেখানে প্রায় পাঁচ হাজার কেওড়াগাছ কেটে ফেলেছে। আশপাশে কিছু গাছ এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। এখন ইজারা পুনর্বহালের পর ওই গাছগুলোর ভবিষ্যৎ হুমকিতে পড়েছে বলে জানান উপকূলীয় বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. রাশেদুজ্জামান। তিনি বলেন, ইজারার কাগজপত্রে উত্তর সলিমপুর লেখা হলেও বেশির ভাগ জায়গা পড়েছে তুলাতলী মৌজায়। তুলাতলী জাহাজভাঙা কারখানার ঘোষিত অঞ্চল নয়। উত্তর সলিমপুর ও তুলাতলী মৌজায় উপকূলীয় বন বিভাগের ১৫০ একর বনায়ন রয়েছে।

ইজারা পুনর্বহালের পর এখন আবার ওই স্থানে জাহাজভাঙা ইয়ার্ড স্থাপনের বাকি কাজ শুরু করেছে কোহিনূর স্টিল। জেলা প্রশাসনের ভেঙে দেওয়া দ্বিতল ভবনটিতে মেরামতকাজ করছে তারা।

প্রসঙ্গত, সীতাকুণ্ডের সমুদ্র উপকূলে বর্তমানে ৩০টির মতো জাহাজভাঙা ইয়ার্ড রয়েছে। এসব ইয়ার্ডে পুরোনো জাহাজ কিনে এনে ভেঙে ফেলা হয়। এরপর ওই লোহা রি রোলিং মিলে গলিয়ে রড তৈরি করা হয়।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ইয়ার্ডের স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেমকে ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। তবে আপিল শুনানিতে কাশেমের কৌঁসুলি দাবি করেন, তাঁরা বনাঞ্চল ধ্বংস করেননি। এই ইয়ার্ডের পেছনে তাঁরা ৭৬ কোটি ১৯ লাখ ৩২ হাজার টাকা খরচ করেছেন।

এদিকে বাতিল হয়ে যাওয়া ইজারা চুক্তি আপিলে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা আদালতের আদেশের পরিপন্থী বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, রাজা কাশেমের ইয়ার্ডের ইজারা বহাল রাখার আইনগত কোনো সুযোগ নেই। কারণ, আপিল বিভাগের একটা আদেশের আলোকে হাইকোর্ট একবার এই একই ভূমিতে ইজারা বাতিল করেছিলেন।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘যখন প্রথমবার হাইকোর্টের আদেশের বরখেলাপ হয়, তখন আমরা আদালত অবমাননার মামলা করেছিলাম। সেই মামলায় সরকারি পক্ষ থেকে আদালতকে জানানো হয়, জেলা প্রশাসন ইজারা বাতিল করেছে। এখন বাতিলকৃত ইজারা যদি বিভাগীয় কমিশনার বহাল করেন, তাহলে আবার আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে।’