বাংলাদেশে মতপ্রকাশে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাধাগুলো এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে

‘দ্য পলিটিকস অব লিটারেচার’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জিয়া হায়দার রহমান। আজ মঙ্গলবার বাংলা একাডেমিতেছবি: প্রথম আলো

কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রায় অকার্যকর ও দুর্বল একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এ সরকারের সময়ে বাংলাদেশে মতপ্রকাশে রাষ্ট্রীয় বাধার বাইরেও যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাধা আছে, সেগুলো এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আজ মঙ্গলবার বাংলা একাডেমিতে ‘দ্য পলিটিকস অব লিটারেচার’ শিরোনামে আয়োজিত এক সেমিনারে এ কথা বলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জিয়া হায়দার রহমান।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা এলে তার সঙ্গে রাষ্ট্রের ক্ষমতাপ্রয়োগের প্রসঙ্গটিও উঠে আসে উল্লেখ করে জিয়া হায়দার বলেন, আওয়ামী লীগের দেড় দশকে প্রকাশ্য ও নির্লজ্জভাবে হাসিনার শাসনব্যবস্থা জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার কঠোরভাবে সীমিত করেছিল। কখনো দমনমূলক আইন প্রণয়ন করে, আবার কখনো দলীয় সন্ত্রাসী ও অনুগত পুলিশ বাহিনী দিয়ে।

কিন্তু আওয়ামী লীগের পতনের পর মতপ্রকাশে শুধু রাষ্ট্রের বাধা নয়, এ বাধার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত, তা স্পষ্ট হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী সরকারের পতনের পর যে প্রায় অকার্যকর ও দুর্বল একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তারা প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা কেবল রাষ্ট্রীয় দমননীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; মতপ্রকাশ ও চিন্তাশক্তির ওপর যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাধাগুলো আছে, সেগুলো এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।’

নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জিয়া হায়দার বলেন, ‘বছরখানেক আগে ঢাকায় এক উন্মুক্ত আলোচনায় বৃষ্টি নামলে অনুষ্ঠানটি ইনডোরে (ঘরের মধ্যে) সরিয়ে নেওয়া হয়। সেখানে দর্শকদের সঙ্গে ঘরোয়া পরিবেশে আলোচনার সময় একটি প্রশ্ন করেছি, বাংলাদেশে একনায়ক পতনের পর মানুষ কি এখন মুক্তভাবে কথা বলতে পারছে? ঘরে উপস্থিত সবাই “না”–সূচক মাথা নাড়লেন। কেউই মনে করলেন না যে তাঁরা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারেন।’

এই ঔপন্যাসিক বলেন, কেউ কেউ বলতে পারেন, নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সময় লাগে। নিশ্চয়ই এমন মানুষও আছেন, যাঁরা এত দিনের অকার্যকর শাসনব্যবস্থার সঙ্গে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যে তাঁরা এই সাময়িক অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপারে নিজের মতপ্রকাশকে অর্থহীন মনে করেন।

মতপ্রকাশে নানা বাধা, নারীর ওপর আক্রমণের ঘটনায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় অন্তর্বর্তী সরকারের কড়া সমালোচনা করেন জিয়া হায়দার।

‘সাহিত্যের বিকাশের জন্য প্রয়োজন চিন্তার স্বাধীনতা’

সাহিত্যের বিকাশের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ, চিন্তার স্বাধীনতা জরুরি মন্তব্য করে ঔপন্যাসিক জিয়া হায়দার বলেন, ‘সুস্থ সাহিত্যচর্চার পরিবেশ আসলে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই প্রতিফলন। অবশ্যই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কিছু শিল্পী মহৎ সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তা নিয়ম নয়, ব্যতিক্রম।’

২০১৪ সালে জিয়া হায়দারের প্রথম উপন্যাস ‘ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো’ প্রকাশের পর আলোচিত হন। এই বইয়ের জন্য তিনি ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যের জেমস টেইট ব্ল্যাক মেমোরিয়াল পুরস্কার পান।

জিয়া হায়দার বক্তব্য শুরু করেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘দ্য থার্ড ম্যান’–এর একটি বিখ্যাত সংলাপ দিয়ে। যেখানে অরসন ওয়েলস অভিনীত চরিত্র হ্যারি লেইম বলে, ইতালিতে যুদ্ধ, রক্তপাত, সন্ত্রাসের মধ্যেও জন্ম নেয় মাইকেল এঞ্জেলো ও দা ভিঞ্চির মতো শিল্পী। আর শান্তিপূর্ণ সুইজারল্যান্ডের অবদান কেবল কুকু ঘড়ি।

‘দ্য পলিটিকস অব লিটারেচার’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জিয়া হায়দার রহমান। আজ মঙ্গলবার বাংলা একাডেমিতে
ছবি: প্রথম আলো

এই সংলাপ নিয়ে নিজের অভিমত তুলে ধরে জিয়া হায়দার বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এটি এমন এক ধারণার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে যে শিল্প দুঃখ ও সংঘাতের মধ্য থেকেই জন্ম নেয়।

‘দ্য থার্ড’ ম্যান একটি ব্রিটিশ চলচ্চিত্র। ১৯৪৯ সালে এটি মুক্তি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী ভিয়েনার দুর্নীতি, বন্ধুত্ব, নৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে এ ছবির কাহিনি নির্মিত হয়।

ব্রেক্সিটের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ঔপন্যাসিক জিয়া হায়দার বলেন, ব্রেক্সিটের সময় ‘থার্ড ম্যান’ ছবির সে সংলাপ একই ভাবনা থেকে উদ্ধৃত করেছিলাম।

জিয়া হায়দার বলেন, ‘ব্রিটেন যখন গণভোটের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তার কিছুদিন পর নিউইয়র্ক টাইমস পাঁচজন লেখক ও শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার ছাপে। ব্রেক্সিট শিল্প ও সংস্কৃতিতে কী প্রভাব ফেলবে, জানতে চাওয়া হয়েছিল তাদের কাছে। একজন বাদে বাকি সবাই মনে করেছিলেন, ব্রেক্সিট তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’

২০১৬ সালে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটি গণভোটের আয়োজন করে। সেখানে ৫২ শতাংশ ব্রিটিশ ভোটার ব্রেক্সিট থেকে বের হয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেন।

জিয়া হায়দার মনে করেছিলেন, ব্রেক্সিট ব্রিটিশ সাহিত্য নতুন স্বর্ণযুগের সৃষ্টি করবে। ‘থার্ড ম্যান’–এর সে সংলাপের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ব্রেক্সিট-পরবর্তী যুক্তরাজ্য হয়তো ইংরেজি সাহিত্যে এক নতুন স্বর্ণযুগের সূচনা করবে—যেখানে লেখকেরা বিংশ শতকের সাহিত্যে দেখা আত্মতুষ্টি ও আপসের মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসবেন।

‘কিন্তু আমি ভুল ছিলাম,’ বলেন জিয়া হায়দার। তাঁর মতে, সাহিত্য বিকাশের জন্য ইতিবাচক শর্ত প্রয়োজন। সুস্থ সাহিত্যচর্চার পরিবেশ আসলে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই প্রতিফলন। অবশ্যই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কিছু শিল্পী সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তা নিয়ম নয়—ব্যতিক্রম।

প্রায় ৪০ মিনিটের মতো রাজনীতি, সাহিত্য ও পশ্চিমা দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক নানা প্রবণতার ওপর বক্তব্য দেন জিয়া হায়দার। বক্তব্য শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে তাঁকে পশ্চিমা দেশগুলোতে বর্ণবাদের উত্থান, ফিলিস্তিন ও গাজা ইস্যুতে দমন–পীড়ন, দেশীয় সাহিত্যর সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের যোগাযোগ কীভাবে বাড়ানো যায়, এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন দর্শক-শ্রোতারা।

জিয়া হায়দার মানবাধিকার নিয়ে পশ্চিমাদের দ্বিচারিতার সমালোচনা করেন। গাজা ইস্যুতে বক্তব্য দিতে গিয়ে অনেকে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন জানিয়ে জিয়া হায়দার বলেন, ‘সেখানে আমাকেও সতর্কতার সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলতে হয়।’

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও হিউম্যানিটিজ বিভাগের চেয়ারপারসন ফেরদৌস আজিমের সভাপতিত্বে সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম। তিনি বলেন, জিয়া হায়দার রহমান তাঁর উপন্যাস ‘ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো’র মাধ্যমে সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর উপন্যাস মানব অস্তিত্বের এক বিশেষ অনুসন্ধান হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে। তিনি শুধু সাহিত্যের ছকে নিজেকে আটকে রাখেননি, গণিত, অর্থনীতি ও আইনের মতো বিষয়ে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।