মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের কক্সবাজার সফর স্থগিত

চীন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ মাসে ১ হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গাকে রাখাইনে পাঠানোর কথা ছিল।

মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নৌকায় করে আসছে বাংলাদেশে
ফাইল ছবি

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর অংশ হিসেবে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদলের কক্সবাজার সফর শিগগিরই হচ্ছে না। ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ বাংলাদেশের কক্সবাজার ও মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলে আঘাত হানতে পারে—এমন বিবেচনায় আপাতত সফরটি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। এর ফলে দুবার ব্যর্থ হওয়ার পর তৃতীয় দফায় প্রত্যাবাসনের চেষ্টা নিয়ে আবারও অনিশ্চয়তা তৈরি হলো।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

ওই বৈঠকে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সফর পেছানোর সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে পররাষ্ট৶ মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (মিয়ানমার অনুবিভাগ) মিয়া মো. মাইনুল কবির, ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এবং মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিয়ো মোয়ে নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

চীনের কুনমিংয়ে গত ১৮ এপ্রিল চীন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ মাসে পাইলট প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গাকে রাখাইনে পাঠানোর কথা ছিল। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে তাঁদের রাখাইনে ফেরত পাঠানো হবে। এরপর এ বছর আরও পাঁচ ধাপে ছয় হাজার রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন হবে রাখাইনে।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ৫ মে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধিদল প্রায় ছয় বছর পর প্রথমবারের মতো রাখাইন ঘুরে আসে। ওই দিন তাঁরা সরেজমিন অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে কক্সবাজারে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রাখাইনে ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ নেই।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, তিন দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে রাখাইন ঘুরে আসা রোহিঙ্গাদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, কক্সবাজারে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের প্রস্তাবিত সফরের আয়োজন এবং হঠাৎ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতামত বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের আস্থায় রেখে প্রত্যাবাসন বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হয়।

ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’কে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সফর পেছানোর কারণ হিসেবে সামনে আনা হলেও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সফরটি স্থগিত হওয়ার পেছনে রাখাইন ঘুরে আসা রোহিঙ্গাদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া মূল ভূমিকা রেখেছে।

মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের কক্সবাজার সফর পিছিয়ে গেছে কি না, জানতে চাইলে গতকাল বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলন উপলক্ষে তাঁর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওদের (মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল) আসার কথা ছিল। সাইক্লোন হবে, এটা তো বিশেষ অবস্থা...আমরা চাইব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে যাক (রোহিঙ্গারা)। কবে যাবে জানি না।’

একই সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘এটা (প্রত্যাবাসন) ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। কাজটি সহজ নয়। আপনারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবেন। এ জন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই।’

চীনের মধ্যস্থতা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কূটনৈতিক একটি সূত্র গতকাল এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, ৫ মে রোহিঙ্গাদের রাখাইন সফরের এক সপ্তাহের মধ্যেই কক্সবাজার আসতে চেয়েছিল মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল। মূলত কক্সবাজার এসে প্রতিনিধিদলটি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলত। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরতে রাজি করানোর বিষয়টি ছিল মুখ্য। কিন্তু মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সফর আয়োজনের ক্ষেত্রে প্রস্তুতিগত কিছু ঘাটতি ছিল।

চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিলেও পশ্চিমা দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনে করে, রোহিঙ্গাদের মৌলিক নাগরিক অধিকার এবং রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত না করে হুট করে মিয়ানমারের প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর কৌশল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে চায়।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের আগের দিন অর্থাৎ গত রোববার বিকেলে বেশ কয়েকজন কূটনীতিক এবং জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীকে নিয়ে বৈঠক করেন জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) এদেশীয় প্রতিনিধি ইয়োহানেস ভ্যান ডার ক্লাউ।

ওই বৈঠকের আগে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলমের সঙ্গে দেখা করেন ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি। এ সময় তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে সক্রিয় ভূমিকা রাখার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। সাম্প্রতিককালে ইউএনএইচসিআর রাখাইনে কাজ করতে পারছে না বলেও তিনি জানান। এ বিষয়ে তিনি বাংলাদেশের সহায়তা চান।

এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যুক্ততার বিষয়ে ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশের পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে আলাদাভাবে চুক্তি করেছে। কাজেই রাখাইনে সংস্থাটির যুক্ততার বিষয় ঠিক করার দায়িত্ব মিয়ানমারের। বাংলাদেশের এ নিয়ে তেমন কিছু করার নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওই বৈঠকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রত্যাবাসন প্রস্তুতির অগ্রগতি ইউএনএইচসিআর প্রতিনিধির কাছে তুলে ধরা হয়। এ সময় জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ ওই কর্মকর্তা রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পাঠানোর আগে তাদের অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি তোলেন।

ওই দিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ফিরে ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম টোশার, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসসহ বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে নিয়ে নিজ কার্যালয়ে বৈঠক করেন। সেখানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হয় বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।

রাখাইনে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাত থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর সাম্প্রতিক ইতিহাসের ভয়াবহতম নৃশংসতা শুরু করে। পরের কয়েক মাসে রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের অক্টোবরের সহিংসতার পর আরও ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশে পুরোনো নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৩৭ হাজার ৩৬৬। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন বাংলাদেশে নিবন্ধিত ৯ লাখ ৬০ হাজার ৫৩৯ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।

২০১৮ সালের নভেম্বরে এবং ২০১৯ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাখাইনে সহায়ক পরিবেশের অভাব থাকায় রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে অপারগতা জানায়। ফলে প্রত্যাবাসনের দুই দফা চেষ্টা বিফলে যায়।

জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ূন কবীর গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে হলে তাদের জীবন–জীবিকার বিষয়ে আস্থার নিশ্চয়তা দিতে হবে। এটা না হলে তো তারা ফিরে যাওয়ার উৎসাহ পাবে না। আর রোহিঙ্গাদের আস্থা তৈরির প্রধান দায়িত্ব মিয়ানমারের হলেও এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও ভূমিকা রাখতে হবে।