গত বছরের ১২ ডিসেম্বর। শীতের এক সন্ধ্যা। চারদিকে কুয়াশার চাদর। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামের আকাশে দেখা মিলল বড় কয়েকটি পাখির। পাখিগুলোর ওপর নজর রাখছিল গ্রামের কিশোর স্বয়ন কুমার। হঠাৎ একটি পাখি তাদের বাড়ির উঠানের একটি গাছে এসে বসল। সেটিকে বেশ অসুস্থ মনে হচ্ছিল। নড়াচড়া করতে পারছিল না।
আঁধার ঘনিয়ে আসায় ঘরে ফিরে আসে স্বয়ন। মাকে বলে পাখিটির কথা। তার মা গ্রামে কবিরাজি চিকিৎসা করেন। ছেলের মুখে পাখিটির বর্ণনা শুনেই বুঝতে পারেন সেটি একটি শকুন। ঠিক করেন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পাখিটি ধরবেন। কবিরাজির কাজে পাখিটির শরীরের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
পরদিন খুব ভোরে মা-ছেলে গেলেন উঠানের সেই গাছতলায়। শকুনটি তখনো ওই গাছের ডালে বসে ছিল। স্বয়ন বড় একটি বাঁশ দিয়ে পাখিটিকে আঘাত করল। মাটিতে পড়ে গেল প্রায় পাঁচ কেজি ওজনের বিশালদেহী শকুনটি। সঙ্গে সঙ্গে সেটির পা দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘরের ভেতর রাখা হলো। কেটে নেওয়া হলো একটি পাখার বড় দুটি পালকও। পরে অন্য পালকগুলোও কাটার পরিকল্পনা ছিল। যেসব নারীর সন্তান হয় না, তাঁদের চিকিৎসায় পালকগুলো ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিল স্বয়নের মায়ের। অথচ এটি একেবারেই কুসংস্কার।
শকুনটি আটকে রাখার খবর দ্রুত আশপাশের লোকজন জেনে গেলেন, ছড়িয়ে পড়ল পুরো পাড়ায়। গ্রামের স্বাধীন ইসলাম নামের একজনের যোগাযোগ ছিল শকুন উদ্ধারকর্মী সোহাগ রায়ের সঙ্গে। তিনি সেদিনই শকুন আটকের খবর সোহাগের কাছে পৌঁছে দিলেন। সোহাগ বগুড়ার সরকারি শাহ সুলতান কলেজের ছাত্র। উত্তরবঙ্গে যেকোনো জায়গায় শকুন আটকা পড়লে তা উদ্ধারের চেষ্টা করেন তিনি।
একটু বলে রাখা ভালো, চণ্ডীপুর গ্রামে আটক হওয়া ওই প্রজাতির শকুনের নাম হিমালয়ী গৃধিনী। শীতকালে হিমালয় অঞ্চল থেকে সেগুলো খাবারের সন্ধানে সমতল ভূমির দিকে পরিযায়ন করে। দীর্ঘ এই ভ্রমণের সময় সেগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের সীমানায় এসে যখন খাবার খুঁজে পায় না, তখন মাটিতে পড়ে যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর এই জাতের প্রায় ১০০টি শকুন আসে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই অসুস্থ হয়ে আটকা পড়ে।
শকুন আটকের খবর শুনে সোহাগ দ্রুত স্বয়নদের বাড়িতে চলে আসেন। কিন্তু মা-ছেলে শকুনটিকে দিতে নারাজ। উপায় না দেখে ওই অঞ্চলের চেয়ারম্যানের কাছে যান সোহাগ। সবাই মিলে বুঝিয়ে মা-ছেলের কাছ থেকে শকুনটি উদ্ধার করা হয়। সেটিকে নিয়ে যাওয়া হয় রংপুর বন অধিদপ্তরের অফিসে। তাঁদের সহযোগিতায় এরপর শকুনটি নেওয়া হয় দিনাজপুরের সিংড়া জাতীয় উদ্যানে। সেখানে বন অধিদপ্তর ও প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএন পরিচালিত শকুন পরিচর্যাকেন্দ্রে রয়েছে।
আইইউসিএনের গবেষকেরা দীর্ঘ তিন মাস চিকিৎসা দিয়ে শকুনটিকে সুস্থ করে তোলেন। সেটির নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক খাদিজা ফেরদৌস। সম্পূর্ণ সুস্থ শকুনটির ওজন বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় সাত কেজি। চলতি বছরের ১৫ মার্চ শকুনটিকে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করা হয়েছে।
যেদিন শকুনটি ছেড়ে দেওয়া হয়, উড়ে যাওয়ার ধরন দেখেই বুঝেছিলাম পাখিটি নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। শকুনটির পিঠে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়ে প্রতিদিনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ২১ মার্চ সেটি ভুটানে যায়। এরপর ৩ এপ্রিল নেপাল হয়ে যায় ভারতের বিহার প্রদেশে। সেখান থেকে ২৯ মে হিমালয় পাড়ি দিয়ে ২ জুন পৌঁছায় সেটির মূল প্রজনন ভূমি চীন ও তিব্বতের কুইনহো অঞ্চলে। শকুনটি প্রায় পাঁচ মাসে ১০ হাজার কিলোমিটারের বেশি ভ্রমণ করেছে। এখন কুইনহো অঞ্চলে প্রজননকাল পার করছে সেটি।
জীবন ফিরে পাওয়া একটি শকুনের গল্প এটি। এমন শত শত হিমালয়ী গৃধিনীর গল্প আমাদের অজানা থেকে যায়। প্রতি শীতে এ প্রজাতির বাচ্চা শকুনগুলো মূলত হিমালয় অঞ্চল থেকে আমাদের দেশে আসে। আমাদের মুক্ত করা শকুনটি আর এ দেশে ফিরবে না। সেটির সংসার থেকে যে বাচ্চার জন্ম নেবে, সেটি আবার এ দেশের সীমানায় এসে বিপদে পড়তে পারে। সেই বিপদ থেকে শকুনগুলোকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই।