‘এই হাহাকার পুরাতন বন্দোবস্তের’

‘গণমাধ্যমে জুলাই ও তারপর’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। পিআইবি মিলনায়তন, ঢাকা। ৯ অক্টোবরছবি: প্রথম আলো

পুরোনো প্রক্রিয়ায় নতুন দুটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমোদন দেওয়া নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘আজকে টেলিভিশন (চ্যানেল) অনুমোদন নিয়ে যে হাহাকার, এই হাহাকার হচ্ছে পুরাতন বন্দোবস্ত এবং যারা মনে করে যে নতুন কোনো মানুষ বা নতুন কোনো মুখ যাতে না আসে, তাদের হাহাকার। এগুলো আমরা বুঝি।’

‘গণমাধ্যমে জুলাই ও তারপর’ শিরোনামে প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পিআইবি মিলনায়তনে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় নতুন টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমোদন প্রসঙ্গে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি যদি এক দিনও থাকি সরকারে, আমি চেষ্টাটাই করব যে আমি নতুন মিডিয়া (গণমাধ্যম) দিয়ে দেব। আমরা যেহেতু ফ্যাসিবাদের মিডিয়া বন্ধ করিনি, আমরা নতুন মিডিয়া দেব।

নতুন মিডিয়ার মাধ্যমে নতুন মুখ আসবে, নতুন ন্যারেটিভ (বয়ান) আসবে, নতুন বক্তব্য আসবে এবং এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে বক্তব্যের লড়াই হবে। যেহেতু আমরা ভায়োলেন্সে (সহিংসতা) যাইনি, ফলে বক্তব্যের বিরুদ্ধে বক্তব্যের লড়াই ও চিন্তার বিরুদ্ধে চিন্তার লড়াইয়ে আমরা যাব। আমরা মনে করি, আমরা অবশ্যই জয়ী হব। এগুলো খুবই স্পষ্ট কথা। এখানে কোনো ধোঁয়াশা রাখার কিছু নেই।’

গণমাধ্যমে সরকার হস্তক্ষেপ করেনি, উল্লেখ করে মাহফুজ আলম বলেন, ‘কিন্তু আমি দেখছি না যে দায়িত্বশীলতা বলতে কোনো কিছু আছে। বরং সেট অব ন্যারেটিভস (একগুচ্ছ বয়ান) বারবার পুশ (সামনে আনা) করা হচ্ছে।...আমরা যে জায়গায় ছিলাম, ওখানে আমাদের টেনে নেওয়া হচ্ছে। যে ন্যারেটিভগুলোতে পা রেখে হাসিনা এত দিন ক্ষমতায় ছিল, সেই ন্যারেটিভগুলোতে আবার ফেরত যাচ্ছে। যে মুখগুলো হারিয়ে গিয়েছিল গত এক বছরে, তাদের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ও বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর নামে আবার ফেরত আনা হচ্ছে। শুধু বিদেশে নয়, দেশেও। আমরা সবই পর্যবেক্ষণ করছি।’

গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা কীভাবে সংঘটিত হয়েছে, সাংবাদিকতার ভেতর দিয়ে মানুষকে কীভাবে হত্যাযোগ্য বানানো হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে গুম-খুন এবং মানবাধিকার পরিস্থিতিগুলো কীভাবে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে—এসব বিষয়ে একটা স্বাধীন তদন্ত করার জন্য জাতিসংঘকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছিল বলে জানান তথ্য উপদেষ্টা। সেই চিঠির উত্তর সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তাঁরা বললেন ইউনেসকোর সঙ্গে কথা বলতে। ইউনেসকো এসে আমাদের বলল, আমরা ওই কাজটা করতে চাই না। বরং আমরা চাই যে কোড অব কন্ডাক্ট (নীতিমালা) তৈরি করে দিতে, গণমাধ্যম সামনে কী করবে। এটা (স্বাধীন তদন্ত) না হওয়াটাতে একটা বড় দাগ রয়ে যাবে। কারণ, এই লোকদের, যাঁরা এই গণমাধ্যমের মালিক-সম্পাদক ছিলেন, তাঁদের অবশ্যই ক্ষমা চাওয়া উচিত, অবশ্যই তাঁদের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ হওয়া উচিত, জনগণের কাছে আসা উচিত।’

আরও সংকট আসছে

সভায় তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ৬ বা ৮ আগস্ট (২০২৪ সাল) সজীব ওয়াজেদ জয় একটা স্ট্যাটাসে ‘মবোক্রেসি’ শব্দটা লিখেছিলেন। আজকে বাংলাদেশকে ঘুরেফিরে ওই শব্দের ভেতরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের একটা ব্যর্থতা, আমি স্বীকার করে নিচ্ছি। আমরা এখানে অনেক কিছু হয়তো সামাল দিতে পারিনি।...যে স্পিরিটের (চেতনা) জায়গা থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের একটা বড় অংশের মানুষ আমাদের জন্য উন্মুখ ছিলেন, আমরা এই মুহূর্তটা হয়তো হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তাঁদের চেতনা, উদ্দেশ্য এবং অভিযাত্রা থেকে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের আকাঙ্ক্ষা মুছে যায়নি। বরং আমি মনে করি, আমাদের আত্মসমালোচনা শুরু করা দরকার। কারণ, সামনে লড়াই সমাগত এবং লড়াই আসছে। ছাত্রনেতৃত্ব বা রাজনৈতিক নেতারা জুলাইয়ের বিপ্লবী জনগণকে ব্যর্থ করেছেন কি না, এই আত্মসমালোচনাটা করা দরকার।’

গত এক বছরে জুলাইকে একধরনের ‘ভ্যানিশ’ (নিশ্চিহ্ন) করে দেওয়ার প্রচেষ্টা ছিল বলেও উল্লেখ করেন মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, সংকট ছিল এবং এখনো সংকট আছে। আরও সংকট সামনে আসছে। এটা অপ্রকাশ্যও নয়। কী ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, তা সবাই দেখছেন।...আস্তে-ধীরে জুলাই অপসৃত হচ্ছে।

যতটুকু সফল হয়, ততটুকুই মঙ্গল

সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহ্‌বুব উল্লাহ্ বলেন, প্রশ্ন উঠতে পারে, জুলাই অভ্যুত্থান করে কী পাওয়া গেল? একটা জিনিস পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত মুক্ত ও স্বাধীনভাবে কথা বলা যাচ্ছে, কেউ বাদ সাধছে না।...এ রকম একটা অভ্যুত্থানের পর হয়তো ভুল হবে। কিন্তু সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিলে বড় ধরনের বিপদের কারণ থাকবে না।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি উল্লেখ করে মাহ্‌বুব উল্লাহ্ বলেন, শক্তিশালী আর্থসামাজিক ভিত্তি না থাকায় সংস্কার সফল হওয়া দুরূহ। তবে যতটুকু সফল হয়, ততটুকুই মঙ্গল। তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজনীতিবিদদের সুমতি আসুক। তাঁরা যাতে সম্মত হন, এই কামনা করি।’

মাহ্‌বুব উল্লাহ্ বলেন, ‘আমরা অনেক সময় দুঃখ করে বলি, এখানে মব কালচার শুরু হয়ে গেছে। এরও একটা সমাজতত্ত্ব আছে। সেভাবে চিন্তা করতে হবে। এখন সমাজে স্থিতিশীলতার জন্য কাজ করতে হবে। তবে সামনে ফ্যাসিবাদ, স্বৈরশাসক বা শোষকের উত্থান হলে আবারও আমাদের গণ-অভ্যুত্থান করতে হবে।’

আরও পড়ুন

সম্পূর্ণ ব্যর্থও হয় না, পূর্ণ সফলও হয় না

আলোচনায় অংশ নিয়ে লেখক–অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘কম মানুষ তো প্রাণ দেয়নি। এত মানুষ যে প্রাণ দিল, এগুলো কি সংখ্যামাত্র? এগুলো একেকটা পরিবার।...কোনো বিপ্লব সম্পূর্ণ ব্যর্থও হয় না, পূর্ণ সফলও হয় না।’

সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও চীনের বিপ্লবের ইতিহাস পড়লে দেখা যাবে, সেখানে বিপ্লবের পরে শত শত হত্যাকাণ্ড হয়েছে। তার তুলনায় আমাদের দেশে বিপ্লব-পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ অনেক কম। দয়া করে আমাকে হত্যাকাণ্ডের উৎসাহদাতা হিসেবে প্রচার করবেন না।’

গত এক বছরে বাংলাদেশে যা দেখা গেছে, তা উৎসাহব্যঞ্জক নয় বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান।

সভার আরেক বিশেষ অতিথি লেখক-গবেষক সাইমুম পারভেজ বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে অনেক গণমাধ্যমই ফ্যাসিবাদী বয়ানকে এগিয়ে নিতে কাজ করেছে। কিন্তু এর মধ্যেও অনেক সাংবাদিক ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে অত্যাচারিত হয়েছেন।’

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ। তিনি বলেন, সমাজে ও রাজনীতিতে এখনো জুলাইয়ের আগুন থাকলেও সেটা সবচেয়ে অস্পষ্ট গণমাধ্যমে। জুলাই গণহত্যার সমর্থকদের এখনো গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে।

এই আলোচনায় সভাপ্রধান ছিলেন পিআইবির পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান ফিরদৌস আজিম। সভার সঞ্চালক ছিলেন পিআইবির তথ্য ও গবেষণা কর্মকর্তা সহুল আহমেদ।

সভায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে পিআইবির পাঁচটি প্রকাশনার (‘তারিখে জুলাই’, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবিতা’, ‘নিরীক্ষা: অভ্যুত্থান মিডিয়া বয়ান’, ‘যে সাংবাদিকদের হারিয়েছি’ এবং ‘ঘটনাপঞ্জি ২০২৪’) মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এর পাশাপাশি সভায় পিআইবির ফ্যাক্ট চেকিং উদ্যোগ ‘বাংলা ফ্যাক্ট’–এর ওয়েবসাইট উদ্বোধন করা হয়।