ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের এক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে আদালত অবমাননার অভিযোগে করা আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে আগামী ১৪ আগস্ট শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেছেন চেম্বার আদালত। আজ সোমবার আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম এদিন ধার্য করেন।
‘একজন চিফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম’—শেখ ফজলে নূর তাপসের দেওয়া এমন বক্তব্যকে আদালত অবমাননাকর উল্লেখ করে আইনজীবী শাহ আহমেদ বাদল আবেদনকারী হয়ে গত রোববার আপিল বিভাগে আবেদনটি করেন। চেম্বার আদালতে আজ আবেদনটি শুনানির জন্য ওঠে। শাহ আহমেদ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক (অন্তর্বর্তীকালীন) কমিটির সদস্য সচিব বলে আবেদনে উল্লেখ করেছেন।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মহসীন রশীদ, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মো. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ ও আবেদনকারী শাহ আহমেদ বাদল।
শুনানিকালে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির ও সম্পাদক মো. আবদুন নুর এবং আওয়ামী লীগ–সমর্থিত অনেক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, মাহবুব উদ্দিন খোকন, কায়সার কামালসহ বিএনপিপন্থী আইনজীবীরাও আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
রায় পক্ষে গেলে ভালো, বিপক্ষে গেলে ফরমায়েশি
ক্রম অনুসারে বিকেল পৌনে চারটার দিকে আবেদনটি শুনানির জন্য ওঠে। তখনো আদালতকক্ষ ছিল আইনজীবীদের উপস্থিতিতে ঠাসা। এ সময় আবেদনের পক্ষে আইনজীবী মো. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ ডায়াসের সামনে দাঁড়ান। আবেদনকারীর অপর আইনজীবী মহসীন রশীদ তখন ডায়াসের দিকে আসেন। তখন তাঁর উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘আপনার ফ্রেন্ডরা (বন্ধুরা) পেছনে আর্গুমেন্ট করছেন। হয় আপনি আর্গুমেন্ট করেন, নতুবা আপনার ফ্রেন্ডদের (বন্ধুদের) আর্গুমেন্ট করতে বলেন।’
এর এক পর্যায়ে আইনজীবী মহসীন রশীদ বলেন, এটি দুর্ভাগ্যজনক, একটি অবমাননার আবেদন। আবেদনের ৫ নম্বর পৃষ্ঠায় অবমাননার মন্তব্যটি উল্লেখ রয়েছে। যে কারণে এটি আনতে হয়েছে।
আদালত বলেন, ‘কী চাচ্ছেন?’ তখন মহসীন রশীদ বলেন, ‘আপনাদের সুবিধাজনক সময়ে ফুল কোর্টে (আপিল বিভাগের) আবেদনটি নির্ধারণ করে দিন। এটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
একপর্যায়ে আদালত বলেন, প্রতিদিনই কোর্ট–কাছারি নিয়ে নানা লোক নানা বক্তব্য দেন। রায় পক্ষে গেলে ভালো, বিপক্ষে গেলে ফরমায়েশি—এ ধরনের মন্তব্য তো হচ্ছে। রাজনীতিবিদেরা অনেক কথা বলেন। সব বিষয়ে কোর্ট–কাছারি কি সমাধান দিতে পারে? তখন আইনজীবী মহসীন রশীদ বলেন, কিন্তু আদালত অবমাননাকর হলে দেখতে পারেন।
মহসীন রশীদের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘আপনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে একটি রায়কে কেন্দ্র করে একজন প্রধান বিচারপতির কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছিল। কারও প্রতিক্রিয়া বা কার্যক্রম ছিল?’ তখন মহসীন রশীদ বলেন, দুর্ভাগ্যজনক ছিল, হওয়া উচিত। আদালত বলেন, সুতরাং কে কোনটা নিয়ে আসেন, এটি বোঝাও মুশকিল হয়। ১৪ আগস্ট দিন ধার্য করা হলো।
আইনজীবীদের উপস্থিতিতে ঠাসা আদালতকক্ষ
আদালত অবমাননার অভিযোগে করা ওই আবেদন শুনানির জন্য কার্যতালিকায় থাকায় বেলা সোয়া দুইটা থেকে আইনজীবীরা আদালতকক্ষে আসতে শুরু করেন। আড়াইটার দিকে এজলাসে আসেন চেম্বার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম। আইনজীবীদের উপস্থিতিতে আদালতকক্ষ তখন ঠাসা। আইনজীবীদের এক অপরের সঙ্গে কথোপকথনের কারণে শব্দও হচ্ছিল।
এ সময় বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, যাঁদের মামলা প্রথম দিকে নেই, পরে আছে, তাঁরা পরে আসতে পারেন। যাঁদের এনরোলমেন্ট নেই, অনুগ্রহ করে থাকবেন না। কোর্টে অনেকে ঢুকতে পারছেন না, শান্ত থাকেন।
এর এক পর্যায়ে আদালত বলেন, পাঁচ মিনিট সময় দিলাম, যাঁদের মামলা নেই, তাঁরা বের হয়ে যাবেন। এরপর এজলাস ত্যাগ করেন বিচারপতি। এরপর যাঁদের মামলা নেই—এমন আইনজীবীদের বেরিয়ে যেতে আহ্বান জানান সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে এজলাসে আসেন বিচারপতি।
এরপর ক্রম অনুসারে মামলার শুনানি গ্রহণ করেন আদালত। বেলা তিনটা ২০ মিনিটের দিকে আবেদনকারীর আইনজীবীসহ কয়েকজন বিএনপিপন্থী আইনজীবী আদালতকক্ষে প্রবেশ করেন। এ সময় আইনজীবীদের মধ্যে কথোপকথন শুরু হয়। একপর্যায়ে আইনজীবীদের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘এভাবে কথা বললে আমাকে উঠে যেতে হবে।’ এরপর পরিস্থিতি শান্ত হয়।
‘একজন চিফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম’—মেয়র তাপসের এমন বক্তব্য নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন গত ২৪ মে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগে তুলে ধরেন এবং অংশবিশেষ পড়ে শোনান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আমীর–উল ইসলাম। গত রোববার (২১ মে) বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এমন মন্তব্য করেন বলে সেদিন উল্লেখ করেন তিনি। সেদিন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা পড়ি, পড়ে দেখি।’ এরপর গতকাল রোববার মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ তুলে ওই আবেদন করেন আইনজীবী শাহ আহমেদ বাদল।