অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আরিফার ছুটে চলা

অসহায় করোনা রোগীদের অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিতে ছুটে চলেছেন আরিফা জাহান। রংপুরের নূরপুর এলাকায়
ছবি: সংগৃহীত

রংপুরে প্রতিদিনই নতুন নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই অসহায়। করোনায় আক্রান্ত কেউ কেউ শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। প্রয়োজন পড়ছে অক্সিজেনের। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন রংপুরের তরুণী আরিফা জাহান (২৩)। তিনি দরিদ্র ও অসহায় করোনা রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিচ্ছেন।

আরিফা জাহান মূলত নারীদের ক্রিকেট প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। সবাই তাঁকে চেনেন বীথি নামে। করোনা রোগীদের অক্সিজেন সেবা দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন আরিফা। তাঁর জীবনের গল্পটাও কষ্টে মোড়ানো। তাঁর বাড়িতেও দুই বেলা খাবার জোটে না। তা সত্ত্বেও তিনি অসহায় মানুষের সেবা দিতে ছুটে চলছেন।

নিজের পরিবারে অভাব-অনটন সত্ত্বেও খবর পাওয়া মাত্র অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ছুটে চলা থেমে নেই আরিফার।

উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর পারিবারিকভাবে বিয়ের আয়োজন করা হয় আরিফার। বিয়ের দিন বধূ সেজে বসে থাকলেও বর না আসায় বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। এরপর তাঁর জীবনের গল্প পাল্টে যেতে শুরু হয়। আরিফা হয়ে ওঠেন দক্ষ ক্রিকেটার। ঢাকায় প্রিমিয়ার লিগও খেলেছেন। পরে অসুস্থতার কারণে তাঁর খেলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাঁকে ফিরে আসতে হয় রংপুরে। আরিফা রংপুরে শুরু করলেন মেয়েদের জন্য বিনা পয়সায় ক্রিকেট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। মেধাবী ও অসচ্ছল মেয়েদের ক্রিকেট শেখাতেই তাঁর উদ্যোগ। প্রতিষ্ঠা করলেন একটি ক্রিকেট একাডেমি। নাম দিলেন ‘উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি’। আরিফার হাত ধরে এখন প্রায় ২৫০ জন মেয়ে ক্রিকেটার হাতেখড়ি নিয়েছেন।

রংপুর নগরের ধাপ এলাকায় রাতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে হাজির হন আরিফা জাহান। সম্প্রতি তোলা
ছবি: সংগৃহীত

করোনা পরিস্থিতিতে আরিফার ক্রিকেট প্রশিক্ষণ বর্তমানে বন্ধ আছে। এই ফাঁকে তিনি সুবিধাবঞ্চিত করোনা রোগীদের সেবায় নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন। অসহায় করোনা রোগীদের তালিকা তৈরি করলেন। একই সঙ্গে দরিদ্র করোনা রোগীদের সহায়তার জন্য আর্থিক সহায়তা চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন। এতে তিনি ব্যাপক সাড়া পেলেন।

অনেকে আরিফাকে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করেন। আরিফা তৈরি করলেন সিলিন্ডার ব্যাংক। সেখান থেকে অসহায় করোনা রোগীদের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিচ্ছেন এই তরুণী। দুই মাস ধরে তিনি এই সেবা অব্যাহত রেখেছেন। অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে রিকশা বা অটোরিকশায় করে আরিফা শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যাচ্ছেন। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত তিনি ৪২ জনকে অক্সিজেন সেবা দিয়েছেন।

আরিফার অক্সিজেন সিলিন্ডার সেবা পেয়েছেন শহরের ধাপ কটকিপাড়ার বাসিন্দা এস এম ওসমান গণি (৬২)। করোনায় আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন তিনি। তাঁকে ৩০ জুলাই অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয়। মুঠোফোনে ওমসান গণি বলেন, ‘এভাবে এত সহজে অক্সিজেন সিলিন্ডার পাব, ভাবতেই চোখে পানি আসে। তাঁর (আরিফার) মঙ্গল কামনা করি।’

জরুরি প্রয়োজনের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার সব সময় মজুত থাকছে। তাঁর এই কাজে যাঁরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।
আরিফা জাহান, নারী ক্রিকেট কোচ
করোনা রোগীদের সেবায় আরিফা জাহানের অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ছুটে চলা। সম্প্রতি রংপুরের নুরপুর এলাকায় তোলা
ছবি: সংগৃহীত

আরিফার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাঁরা নিতান্তই খুব কষ্টে আছেন, দেখার কেউ নেই, কিংবা দরিদ্র—এমন লোকজনদের অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে সহায়তা করছেন তিনি। তাঁর এই স্বেচ্ছাসেবী কাজের সঙ্গে অনেকেই যুক্ত হয়েছেন। আরিফা বলেন, জরুরি প্রয়োজনের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার সব সময় মজুত থাকছে। তাঁর এই কাজে যাঁরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।

আরিফার বাড়ি রংপুর নগরের নূরপুর এলাকায়। তাঁর বাবার নাম মফিজুল ইসলাম। একটি তেল পাম্পে চাকরি করলেও সেই চাকরিও চলে যায়। তাঁর মা মাজেদা বেগম গৃহিণী। বড় ভাই অটোরিকশাচালক। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। আর ছোট ভাই নবম শ্রেণিতে পড়ছে ইউসেফ স্কুলে। নিজের পরিবারে অভাব-অনটন সত্ত্বেও খবর পাওয়া মাত্র অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ছুটে চলা থেমে নেই আরিফার।