অন্য রকম যোদ্ধা শিক্ষক জাহাঙ্গীর

কক্সবাজার সিটি কলেজে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন প্রভাষক জাহাঙ্গীর আলম। ছবি: প্রথম আলো
কক্সবাজার সিটি কলেজে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন প্রভাষক জাহাঙ্গীর আলম। ছবি: প্রথম আলো

করোনার সংক্রমণ রোধে গত ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। সেপ্টেম্বরের আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলে চালুর লক্ষণ নেই। দেশের অন্য খাতের মতো শিক্ষা খাতেও এখন ভঙ্গুর দশা। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারি নির্দেশনায় সারা দেশে কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন ক্লাস চালু করেছে। এর মধ্যে কক্সবাজার সিটি কলেজ অন্যতম।

২০ মার্চ থেকে কলেজটির প্রায় ২০০ শিক্ষক অনলাইন ক্লাস শুরু করেন। গত চার মাসে তাঁরা হাজারের বেশি অনলাইনে ক্লাস নেন। এর মধ্যে কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম একাই সম্পাদন করেন ১৬৮টি ক্লাস। ২৪ মার্চ থেকে তিনি ক্লাস শুরু করেন। আজ সোমবারও তিনি দুটি ক্লাস নেন।

জাহাঙ্গীর আলম পদার্থবিজ্ঞানের একাদশ, দ্বাদশ ও সম্মান শ্রেণির ১ম ও ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে তিনি ১৫৩টি অনলাইন ক্লাসের ভিডিও বিভিন্ন পেজে আপলোড করেছেন।

অনলাইন ক্লাসগুলোর ভিডিও কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অনলাইন গ্রুপ (Cox'sbazar city college), অনলাইন পেজে (Department of Physics-Cox's Bazar City College) পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি একই ভিডিও ইউটিউব চ্যানেল (PLARCBD), জেলা প্রশাসনের অনলাইন পেজ (DC Cox's Bazar), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন পেজ (Online Classroom in National University, Bangladesh) এবং অনলাইন গ্রুপ (Online Classroom in National Univercity, Bangladesh (Group), বদরখালী ডিগ্রি কলেজ-অনলাইন পেজে প্রতিনিয়ত আপলোড হচ্ছে।

শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ২৪ মার্চ থেকে তিনি কলেজের একটি কক্ষ থেকে অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করছেন। ২৭ জুলাই পর্যন্ত ১৬৮টি ক্লাস সম্পাদন করেছেন। এর মধ্যে ১৫৩টি অনলাইন ক্লাসের ভিডিও বিভিন্ন অনলাইন পেজে আপলোড দিয়েছেন। ইতিমধ্যে কলেজের ৩০০ শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন কলেজের অন্তত ১ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী ভিডিওগুলো সংগ্রহ করে শিক্ষার উন্নতি ঘটাচ্ছেন।

কলেজের অধ্যক্ষ ক্য থিং অং বলেন, করোনা মহামারিতেও টানা চার মাসে একাধারে ১৬৮টি অনলাইন ক্লাস করে শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম নজির স্থাপন করেছেন। শিক্ষকতার মহান পেশাকে তিনি সমুজ্জ্বল রেখেছেন। তাঁর মতো এত বেশিসংখ্যক অনলাইন ক্লাস নেওয়ার নজির দেশে সম্ভবত অন্য কোনো শিক্ষকের নেই।

কক্সবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্র আলীরজাহাল এলাকায় সবুজ অরণ্যে ঘেরা সিটি কলেজের অবস্থান। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজের শিক্ষার্থী ১২ হাজারের বেশি। শিক্ষক আছেন ২০৫ জন।

সম্প্রতি কলেজে গিয়ে দেখা যায়, পুরো ক্যাম্পাস ফাঁকা। তবে ব্যস্ত সময় পার করছেন অধ্যক্ষ ক্য থিং অং। কলেজের বিভিন্ন কক্ষে অনলাইন ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষকেরা। অধ্যক্ষ ঘুরে ঘুরে সেসব ক্লাসের তদারক করছেন। একটি কক্ষে গিয়ে দেখা যায় জাহাঙ্গীর আলমকে। তখন তিনি সম্মান পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস নিচ্ছিলেন।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, করোনা মহামারিতে সবাই হোম কোয়ারেন্টিনে। কিন্তু তাঁরা (শিক্ষক) ঘরে বসে থাকতে পারছেন না। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রতিদিন একাধিক ক্লাস নিতে হচ্ছে। অনলাইনে যেসব শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকতে পারছে, তারা উপকৃত হচ্ছে। নানা কারণে যেসব শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস ধরতে কিংবা অংশ নিতে পারছে না, তাদের জন্য ক্লাসের ভিডিও আপলোড করে দেওয়া হচ্ছে। পেজ থেকে ভিডিও নামিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩০০ শিক্ষার্থী ভিডিও সংগ্রহ করেছে।

কলেজের পদার্থবিদ্যা সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জাহেদুল ইসলামের বাড়ি শহরের বাহারছড়া এলাকায়। তিনি নিয়মিত অনলাইন ক্লাসে অংশ নিচ্ছেন। জাহেদুল বলেন, তাঁর অনেক বন্ধু অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারেন না। ইন্টারনেট দুর্বলতা কিংবা বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে এটা হচ্ছে। তিনি ক্লাসের ভিডিও বন্ধুদের কাছে পাঠান। এতে বন্ধুদের উপকার হচ্ছে।

একই বিভাগের আরেক ছাত্র সাইফুদ্দিন রাজের বাড়ি রামু উপজেলায়। সাইফুদ্দিন বলেন, সারা দিন তিনি বাড়ির কাজে ব্যস্ত থাকলেও রাতে শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমের অনলাইন ক্লাসের ভিডিও দেখেন। এভাবে অন্য কলেজের শিক্ষার্থীরাও পাঠ নিতে পারছেন।

গত ৩০ জুন দেশের ১০০ জন শিক্ষকের সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন আর রশিদের জুম কনফারেন্স হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোনাজ আহমেদ নুর। সভায় অন্য শিক্ষকদের তুলনায় অধিক অনলাইন ক্লাস সম্পাদন করায় জাহাঙ্গীর আলমের ভূয়সী প্রশংসা করেন উপাচার্য হারুন অর রশিদ ও মোনাজ আহমেদ নুর।

কলেজের অধ্যক্ষ ক্য থিং অং বলেন, প্রভাষক জাহাঙ্গীর আলম একজন সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ, পরিশ্রমী মানুষ। তিনি একজন শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক। করোনাকালে তাঁর অনলাইন ক্লাসগুলো সারা দেশের হাজারো শিক্ষার্থীর উপকারে আসছে।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অধ্যক্ষের তাগিদ না থাকলে এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হতো না। করোনাকালে যেখানে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, সেখানে অধ্যক্ষ তাঁদের ঘর থেকে ধরে এনে শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করছেন। দেবদূতের মতো তিনি লেগে না থাকলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় অনেক পিছিয়ে পড়ত। ৭ জুলাই থেকে অধ্যক্ষের নির্দেশনায় কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অনলাইন পরীক্ষাও শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে ১০টি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে।