অবৈধ জালে জাটকার সর্বনাশ

ভোলা সদর, বোরহানউদ্দিনসহ বিভিন্ন উপজেলায় অবৈধ জাল পাতা হচ্ছে। এতে ১ নভেম্বর শুরু হওয়া জাটকা সংরক্ষণ অভিযান ব্যাহত হচ্ছে।

  • তেঁতুলিয়া ও মেঘনা নদীর বিভিন্ন স্থানে অবৈধ বেহুন্দি, চরঘেরা ও মশারি জাল পাতা হচ্ছে।

  • অবৈধ জালে আটকা পড়ে মাছের রেণু, পোনা, জাটকাসহ জলজ প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে।

  • এভাবে রেণু ও পোনা মরে যাওয়ায় ইলিশসহ অন্যান্য মাছও বড় হতে পারছে না।

সোহাগ মাঝি (৩৪) ভোলার তেঁতুলিয়া নদীতে বৃহস্পতিবার ভোরে মাছ ধরতে নেমে সকাল ১০টা পর্যন্ত মাত্র দেড় শ টাকার মাছ পেয়েছেন। বাবা-ছেলে মিলে যদি ৫০০ টাকার মাছ না ধরতে পারেন, তাহলে বাজার করতে পারবেন না। আর বাজার না করলে দুপুরে ঠিকমতো খাওয়া হবে না। কয়েক দিন ধরেই নদীতে মাছের আকাল চলছে। এত বড় নদীতে মাছের আকাল কেন জানতে চাইলে সোহাগ বলেন, ‘নদীত বিন্দি (অবৈধ বেহুন্দি জাল) ভরি গেছে। এই জালে মাছের পোনা, রেণু, জাটকাসহ সব আটকে যায়। নদীর মাছ বড় অওনের সুযোগ দ্যায় না, মাছ নাই, পামু কোইত্তোন!’

সোহাগের বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের চটকিমারা চরে। তেঁতুলিয়া নদীতে অবৈধ ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে মাছ ধরায় সোহাগের মতো দুরবস্থা জেলার ৫০ হাজার জেলে পরিবারের। জেলা প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগ অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরা বন্ধে অভিযান চালালেও তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। এতে জাটকা সংরক্ষণ অভিযানও ব্যাহত হচ্ছে।

স্থানীয় কয়েকজন জেলে বলেন, বড় ফাঁসের জাল দিয়ে ইলিশসহ অন্যান্য বড় মাছ শিকার করা হয়। এ জাল নদীর মাঝে পাততে হয়। যাদের বড় ট্রলার আছে তারাই মেঘনা, সাগর ও সাগর মোহনায় মাছ ধরতে যেতে পারে। ডিঙিনৌকার জেলেরা উত্তর ও মধ্য তেঁতুলিয়া নদীতে জাল পাতে। কিন্তু নদী ও নদীর মধ্যে জেগে ওঠা চরের আশপাশ দখল করে শত শত অবৈধ জাল পাতা হচ্ছে। এসব জালে জাটকাসহ অন্যান্য মাছের রেণু, পোনাসহ সব মাছ ধরা পড়ছে। এ কারণে বড় জালে মাছ পড়ছে না।

ভোলা সদর উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. জামাল হোসেন বলেন, ১ নভেম্বর আবার শুরু হয়েছে জাটকা সংরক্ষণ অভিযান। চলবে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত। ২২ দিনের ইলিশ প্রজনন মৌসুমে মা-ইলিশ যে ডিম ছেড়েছে, সেই ডিম থেকে জন্ম নেওয়া জাটকা বড় ইলিশে পরিণত হওয়ার জন্য এ সংরক্ষণ অভিযান।

অবৈধ জালের কারণে মাছের পোনা ও রেণু নষ্ট হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে জামাল হোসেন আরও বলেন, নদীতে কারেন্ট, বেহুন্দি, চরঘেরা, মশারি জাল পাতা সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ, এসব ছোট ফাঁসের জালে মাছের রেণু, পোনা, জাটকাসহ জলজ প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, তেঁতুলিয়া নদীর ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার জয়া, গঙ্গাপুর, সদর উপজেলার কোড়ালিয়া, বালিয়া, শান্তিরহাট, বাঘমারা, দক্ষিণ ভেলুমিয়া, পাকারমাথা শাজাহানবাজার, ভেদুরিয়া চটকীমারা এলাকায় বেহুন্দি, চরঘেরা ও মশারি জাল জাল পাতা হয়েছে।

তেঁতুলিয়া নদীর মতো মেঘনা নদীর ভোলার চর, কানিবগার চর, গাজীপুর, মধুপুর, চর বৈরাগী, মদনপুরের পুবে, চরজহিরুদ্দিন, কলাতলীর চর, চরডেম্পিয়া, চরপাতিলা, ঢালচর, বাসান চরের আশপাশে ডুবোচরে অবৈধ জাল পেতে রাখতে দেখা যায় । মা-ইলিশের নিষেধাজ্ঞা শেষ হতে না হতে এসব অবৈধ জাল পাতা শুরু হয়েছে।

জেলেরা জানায়, বেহুন্দি জাল পাততে হলে জালের সঙ্গে বাঁশ-খুঁটি, লোহার রড, ড্রাম, ইট-পাথর ভর্তি বস্তা দরকার হয়। মোটা সুতোয় বোনা বেহুন্দি জালের ত্রিভুজ আকারের মুখ। স্রোতের টানে জালের মুখের মধ্যে বড় মাছ, মাছের রেণু-পোনা, জাটকা, জলজ প্রাণী—সব প্রবেশ করে আর বের হতে পারে না।

সদর উপজেলার কোড়ালিয়া বাজারের সামনে তেঁতুলিয়া নদীর তীরে দাঁড়িয়ে একদল জেলে আক্ষেপ করে বলেন, নদীর মধ্যে বিছানার মতো বিছিয়ে রাখা হয় বিন্দি জাল। জেলেরা কষ্ট করে এসব জালের ফাঁকে- ফাঁকে ছান্দি জাল (বড় জাল) পাতে। জোয়ার-ভাটায় ঢেউ ও পানির স্রোতে অনেক সময় জাল ভাসিয়ে এসব অবৈধ জালের বাঁশ-খুঁটির সঙ্গে আটকে যায়। তখন চিকন সুতার বড় জাল ছিঁড়ে যায়।

ভেদুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বলেন, তেঁতুলিয়া নদীতে অবৈধ জাল পাতার কারণে শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। তিনি ইউপি সদস্য ও চৌকিদারদের নদীতে যাতে এসব জাল কেউ না পাতে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।

ভোলা ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী ও জেলে সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, এসব অবৈধ জাল যেখানে পাতে, সেখানে ছোট ছোট নৌকার অসহায় জেলেরা ইলিশজাল ফেলতে পারে না। অবৈধ জাল নদী স্থায়ীভাবে দখল করে রাখছে। মৎস্য বিভাগ যদি অবৈধ জাল পাতা বন্ধ করতে না পারে, তাহলে কমপক্ষে ৫০ হাজার ক্ষুদ্র জেলের পরিবারকে অনাহারে দিন কাটাতে হবে।

ভোলা জেলা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি ও মৎস্য বিশেষজ্ঞ নুরুল ইসলাম বলেন, অবৈধ জাল পাতা বন্ধ না হলে মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে না। অবৈধ জালের কারণে নদী মাছশূন্য হয়ে যাবে। অবৈধ জাল একদিকে যেমন মাছের রেণু-পোনা, ইলিশ-জাটকা, জলজ প্রাণী ধ্বংস করছে, তেমনি নদীর নাব্যতা হ্রাস করে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের প্রধান আনিসুর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর ২২ দিনে (৪-২৫ অক্টোবর) নদীতে আসা ৫১ দশমিক ৭০ শতাংশ মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে। ইলিশ আশাতিরিক্ত ডিম ছেড়েছে। যদি অবৈধ জালে জাটকা আহরণ না হয়, তবে বছর শেষে পৌনে ৬ লাখ থেকে ৬ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন হতে পারে।