অযত্নে আছে ভাওয়াল রাজাদের রাজ শ্মশানেশ্বরী

অবহেলায় পড়ে আছে রাজ শ্মশানেশ্বরী। গাজীপুরের উত্তর ছায়াবীথি এলাকায়
প্রথম আলো

ঐতিহাসিক ভাওয়াল পরগনাই এখন গাজীপুর জেলা। ভাওয়াল রাজারা না থাকলেও তাঁদের স্মৃতি-স্মারক গাজীপুরে রয়ে গেছে। তবে নানামুখী দখলে ও রাষ্ট্রের অযত্ন-অবহেলায় সেসব স্মৃতিচিহ্ন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রাজ শ্মশানেশ্বরী।

সংস্কারের অভাবে রাজ শ্মশানেশ্বরীতে গাছপালা জন্মেছে। ফাটল দেখা দিয়েছে স্থাপনায়।

গাজীপুর জেলার প্রাণকেন্দ্র জয়দেবপুরে অবস্থিত ভাওয়াল রাজ শ্মশানেশ্বরী দেশের উল্লেখযোগ্য একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। ভাওয়াল জমিদার পরিবারের সদস্যদের শব সৎকারের জন্য ভাওয়াল রাজবাড়ি থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে চিলাই নদীর দক্ষিণ পাশে ভাওয়াল রাজ শ্মশানেশ্বরী নামের এ সমাধিসৌধ স্থাপন করা হয়। সেখানে শ্মশানের জমি আছে প্রায় ছয় একর।

গাজীপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা জানান, প্রায় ছয় শ বছর আগে মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। রাজ-রাজেশ্বরী মন্দির হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। এর নির্মাণে ব্যবহার করা হয় চিটাগুড়, চুন-সুরকি ও পোড়ামাটি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক বিঘা জমির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে জরাজীর্ণ ও ভগ্নপ্রায় ঐতিহাসিক ‘রাজ-রাজেশ্বরী মন্দির। মধ্যযুগীয় নানা পুরাকীর্তির নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পুরো মন্দিরে। গাছপালা আর লতাগুল্মে ছেয়ে গেছে পুরোনো মন্দির। খসে পড়েছে পলেস্তারা। দেখা দিয়েছে ফাটল। পুরো মন্দির দখলে নিয়েছে চামচিকা ও আর হরেক রকম সরীসৃপ। ভেতরের অংশে চার-পাঁচটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগের চারপাশে রয়েছে ঘূর্ণমান টানা অলিন্দ। মন্দিরের পেছন কোণে রয়েছে একটি ছোট কামরা। রাজ শ্মশানেশ্বরীতে ভাওয়াল রাজার পরিবারের মৃত সদস্যদের নামে নামফলক ও সৌধ ছাড়াও শ্মশান চত্বরে মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত সাত স্তম্ভবিশিষ্ট একটি সমাধিস্থল আছে। শিবমন্দিরও আছে।

স্থানীয় লোকজন জানান, ভাওয়াল রাজবাড়ি শ্মশান গাজীপুরের একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। কিন্তু এখানে এর কোনো নির্মাণকাল লেখা নেই। নেই কোনো ফলক। আছে শুধু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড। সেখানেও নির্মাণের সময়কাল লেখা নেই।

স্থানীয় লোকজন জানান, দিন দিন শ্মশানের জমি দখল হওয়ায় কিছুদিন আগেই এর চারদিকে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়। এর ভেতরে আছে একটি শিব মন্দির। সেটিও বহু বছর আগের। কিন্তু নতুন রং করা হয়েছে। এর পূর্ব পাশে শ্মশান মঠ। সামনের দিকে তিনটি মঠের নির্মাণশৈলী সাদামাটা। বাকি চারটি মঠে অনেক কারুকাজ করা হয়েছে। কিছু কিছু অংশ ভেঙে গেছে। সামনে একটি মাঠের মতো স্থান আছে। এর পূর্ব দিকে আছে একটি জরাজীর্ণ পুকুর। পুকুরের পাশেই শ্মশান।

ইতিহাস-ঐতিহ্যে গাজীপুর বইয়ের লেখক মনির মুননা জানান, ১৮৫৬ সালে কালী নারায়ণ রায় বংশানুক্রমে জমিদারির দায়িত্ব পান। জমিদারি পরিচালনার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রায় চৌধুরী এবং রাজা উপাধিতে ভূষিত করে। সে বছরই তিনি মারা যান। কালী নারায়ণের শাসনামলে ভাওয়াল রাজবাড়ী এবং ভাওয়াল রাজ শ্মশানেশ্বরী নির্মাণ করা হয়। ভারতের কলকাতার বিখ্যাত স্থপতি কামাখ্যা রায় এ শ্মশানেশ্বরীর নকশা করেন।

ভাওয়াল রাজ শ্মশান মন্দিরের সভাপতি নেপাল চন্দ্রবর্তী বলেন, ভাওয়াল রাজ শ্মশানের জায়গা ১৭-১৮ বিঘা। ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্র ছয় বিঘা। বাকি জমি প্রভাবশালীরা ইজারার নামে দখল করে নিয়েছেন। এখানে কালী, সরস্বতী, বাসন্তী ও শিবপূজা হয়।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভাওয়াল রাজ শ্মশান একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটি রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। এটি রক্ষার জন্য এরই মধ্যে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। আরও কাজ করা হবে।’