মৌলভীবাজারের সুজানগর
আগর–আতর ব্যবসায় মন্দা
এসব পণ্য মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু দুই বছর সেখানকার বাজার বন্ধ থাকায় ব্যবসাটিতে এখন মন্দা চলছে।
আদিব মজিদের আগর-আতরের ব্যবসা। আগে বছরে কম করেও ৪০ কেজি আগর কাঠ রপ্তানি করতেন। এখন ১৫ কেজিও পারেন না। করোনার পর তাঁর আতরের কারখানা একদম বন্ধ ছিল। এখন কিছুটা চালু হলেও ব্যবসা নেই। সিংহভাগ শ্রমিক বেকার। দিনের খরচই এখন সংগ্রহ করতে পারছেন না।
শুধু আদিব মজিদ নন, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সুজানগর এলাকার অধিকাংশ আগর-আতর ব্যবসায়ী করোনার ধাক্কা সামলে উঠতে পারেননি। এখানকার উৎপাদিত পণ্য মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু টানা দুই বছর সেখানকার বাজার বন্ধ থাকায় ব্যবসাটিতে এখন মন্দা চলছে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। বেকার হয়ে পড়েছেন অনেক শ্রমিক।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুজানগরের স্থানীয় লোকজন ৩০০ বছর ধরে বংশানুক্রমিক আগর-আতরের ব্যবসা করছেন। বর্তমানে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ এর সঙ্গে জড়িত। কারও আছে আগরের গাছ। কেউ আবার আগর কাঠ পৃথক করেন। কেউবা প্রক্রিয়াজাত আগর কাঠ ও আতর স্থানীয় উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে কিনে বিদেশে রপ্তানি করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সুজানগরে গড়ে উঠেছে ছোট–বড় প্রায় ৩০০ কারখানা। এই আগর-আতরের প্রধান ক্রেতা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ। সেখানে চাহিদা ভালো থাকলে সুজানগরেও ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো চলে।
কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে সুজানগরেও এর প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন দেশের ক্রেতার আসা বন্ধ হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের বাজার বন্ধে সুজানগরও স্থবির হয়ে পড়ে। এতে কোটি কোটি টাকার আগর কাঠ ও আতর রপ্তানি করা যায়নি। প্রায় পাঁচ হাজার নারী-পুরুষ বেকার হয়ে পড়েন। বেশির ভাগ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।
গত রোববার সুজানগরে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক কারখানা বন্ধ। ব্যবসায়ী আবদুল বাতিনের কারখানাটি চালু আছে। চুলায় আগর কাঠ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। ২০০৫ সাল থেকে তিনি ব্যবসা শুরু করেছেন। বছরে প্রায় ছয় মাস কারখানায় ১৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। আবদুল বাতিন বলেন, ‘সুজানগরের ঘরে ঘরে আগর-আতরের কারবার। প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে এ ব্যবসায় জড়িত। বর্তমানে অবস্থা খারাপ। আমার প্রায় ১৫ লাখ টাকার আতর ও আগর কাঠ পড়ে আছে। বিক্রি করতে পারছি না।’
শ্রমিক রুহুল আমিন বলেন, দুই বছর ধরে কাজ নেই। বেকার সময় কাটাচ্ছেন। খুব বেশি কষ্টে আছেন।
ব্যবসায়ীরা বলেন, আগরগাছ আগর-আতরের উৎস। আগরগাছে একধরনের পোকা আক্রমণ করে। তাতে গাছের শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। তখন অসুখে আক্রান্ত গাছটিই মূল্যবান হয়ে ওঠে। প্রাকৃতিকভাবে অসুস্থ গাছের দাম বেশি, উৎপাদিত পণ্যের মানও ভালো হয়। যে গাছে পোকা আক্রমণ করে না, সে গাছে লোহার পেরেক ঠুকে কৃত্রিম ক্ষত তৈরি করা হয়। গাছের শরীরে ক্ষতগুলো পুরোনো হয়ে এলে গাছ কেটে সেই ক্ষতের অংশটুকু আলাদা করা হয়। পরে এই ক্ষত অংশটুকু ডেকচিতে ১০ থেকে ১২ দিন জ্বাল দিলে তা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় আতর বেরিয়ে আসে। ৪০ কেজির একটি ডেকচি থেকে ৮ থেকে ১০ তোলা (১৩ গ্রাম) আতর পাওয়া যায়। প্রতি তোলা আতরের দাম সাত থেকে আট হাজার টাকা। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে আগর কাঠকে ‘উদ’ বলে। এই কাঠ পুড়িয়ে ঘরে ধোঁয়ার সুগন্ধ ছড়ানো হয়। গুণগত মান অনুযায়ী এক কেজি কাঠের টুকরার দাম পাঁচ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনছারুল হক বলেন, আগর-আতরের ব্যবসা একসময় ভারতের কাছে চলে গিয়েছিল। পরে আবার ফিরে এসেছে। গত বছর বৈধভাবে ১০০ কোটি টাকার আগর-আতর রপ্তানি হয়েছে। এখন ব্যবসা মন্দা চলছে। সব ব্যবসায়ীর কাছে প্রচুর আগর-আতর জমা। বিক্রি করতে পারছেন না। তবে এই অবস্থা থাকবে না। এটি একটি সম্ভাবনাময় পণ্য। এটার ভবিষ্যৎ আছে। করোনার প্রকোপ কমলে আবার নতুনভাবে এই ব্যবসা জমে উঠবে। সরকারও আগর-আতরকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। বিশেষ বিসিক শিল্পনগরী তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। প্রণোদনা দিচ্ছে।