আতঙ্ক নিয়ে রাতে ঘুমাতে যায় ৫ হাজার পরিবার

গত বর্ষা থেকে ১৫০টি পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে। ঘরবাড়ি হারানোর আশঙ্কায় আরও ৫ হাজার পরিবার।

ভোলা সদরের রাজাপুর ইউনিয়নের জোড়খাল থেকে চর মোহাম্মাদ আলী পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটারে ইলিশা নদীর তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত বুধবারছবি: প্রথম আলো

ভোলা সদর উপজেলায় ইলিশা নদীর ভাঙনে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা ডুবে যাচ্ছে। উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের জোড়খাল থেকে চর মোহাম্মাদআলী পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার নদীতীরে ভাঙন তীব্র হচ্ছে। এ দীর্ঘ নদীতীরের ভাঙনে গত বর্ষা থেকে ১৫০টি পরিবার তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে বাস্তুহারা হয়েছে। ভাঙনে ঘরবাড়ি হারানোর আশঙ্কায় আছে আরও প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার।

নদীতীরে কংক্রিটের ব্লক ফেলে তীর সংরক্ষণের দাবিতে ইউনিয়নবাসী দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। গত সোম ও মঙ্গলবার গ্রামবাসী মানববন্ধন ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কয়েকবার ঢাকায় প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে। কিন্তু পাস হচ্ছে না। এ কারণে ভাঙন প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেছেন এলাকাবাসী।

রাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রেজাউল হক মিঠু চৌধুরী বলেন, ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়ন ২৫ বছর ধরে ভাঙছে। এ দীর্ঘ সময়ে কমপক্ষে ১০টি মৌজার কয়েক হাজার একর জমি-বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। বর্তমানে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ, পাঁচ-ছয়টি স্কুল, মাদ্রাসা-মসজিদ, বাজার, রাস্তাঘাটসহ পাঁচ হাজার পরিবার হুমকির মুখে আছে। চেয়ারম্যান বলেন, ‘ভাঙনের মুখে ব্লক ফেলে তীর সংরক্ষণ জরুরি। এলাকাটিকে রক্ষায় এগিয়ে আসার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে বিনীত অনুরোধ করছি।’

ঘরের ভিটা জোয়ারের তোড়ে ভেঙে যাচ্ছে। স্বামী নদীতে মাছ ধরেন। বাচ্চাদের নিয়ে রাতবিরাতে ভাঙা ঘরে থাকতে ভয় করে।
তাছনুর বেগম, স্থানীয় গৃহবধূ

গত বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, জোড়খাল থেকে চর মোহাম্মাদআলী পর্যন্ত ভাঙন মানুষের ঘরের দরজায় চলে এসেছে। অস্বাভাবিক জোয়ারে মাটির ঘরের ভিটা ধুয়ে নিয়ে গেছে। এসব এলাকায় মানুষের ঘর থেকে বেরোনের কোনো রাস্তাঘাট নেই। সব ধুয়ে গেছে নদীতে। দেখে মনে হয়, নদীতে দাঁড়িয়ে আছে ঘর। জোয়ার উঠে মিঝি বাজার থেকে জোড়খাল সড়ক, ছায়েদ আলীর দোকান থেকে উত্তরে রামদাসপুর স্কুল সড়ক, রাজাপুর বানিয়ারচর থেকে জংশন মাদ্রাসা সড়ক, দারগারখাল বাজার থেকে আবদুল খালেক ডাক্তার বাড়ি, চরসিতারাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সড়কসহ ১৫টি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে গেছে একাধিক কালভার্ট।

ভাঙনের মুখে আছে রাজাপুর ল্যাবরেটরি, রাজাপুর, উত্তর-পশ্চিম কন্দ্রকপুর, কোড়ালিয়া ও চর মোহাম্মাদআলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাজাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ একাধিক মসজিদ-মাদ্রাসা ও বাজার। গত বছর যে বালুভর্তি বস্তা ফেলা হয়েছে, তা ভেসে গেছে।

ভিটাবাড়ি রক্ষার আকুতি

হানিফ হাওলাদারের (৬১) প্রায় চার একর কৃষিজমি ছিল। ছিল ভিটাবাড়ি, ফলের বাগান। নদীর ভাঙনে সব নিয়ে গেছে। আছে শুধু ঘর-ভিটাটুকু। বাড়ি তাঁর রাজাপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের জোড়খাল এলাকার ইলিশা নদীর তীরে। একসময় নদী অনেক দূরে ছিল। এখন অরক্ষিত তীরে ঝুলন্ত পাখির বাসার মতো, আজ ভাঙে, কাল ভাঙে, সেই ঘরে স্ত্রী নুর জাহান বেগমকে (৫৮) নিয়ে বসবাস করছেন চরম শঙ্কার মধ্যে। নিয়মিত জোয়ার ওঠার কারণে ঘরের আশপাশে সবজি-আনাজও লাগাতে পারেন না। নিজের কৃষিকাজ দিয়ে এখন শ্রম দেন অন্যের বাড়ি।

হানিফ হাওলাদারের মতো প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার এখন আতঙ্ক নিয়ে রাতে ঘুমাতে যায়, না জানি রাতে ভাঙনে-জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাদের সবার বাড়ি ও জমি আছে ইউনিয়নের জোড়খাল থেকে চর মোহাম্মাদআলী পর্যন্ত ইলিশা নদীতীর ঘেঁষে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাসানুজ্জামান বলেন, সর্বশেষ সদর উপজেলার রাজাপুর, ইলিশা, ধনিয়া ও শিবপুর ইউনিয়ন মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার মেঘনার তীর সংরক্ষণের একটি প্রকল্প একনেকে জমা আছে। পাস হলে আগামী শীতে কংক্রিটের ব্লক ফেলে তীর সংরক্ষণের কাজ শুরু হবে।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই সাড়ে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে রাজাপুরের ভাঙনকবলিত মাত্র দুই কিলোমিটার অংশ পড়েছে। প্রকল্প পাস হলেও বাকি দুই কিলোমিটার নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

বাসিন্দারা জানান, যখন অস্বাভাবিক জোয়ার ওঠে, তখন ইউনিয়নের ২, ৩, ৪, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড প্রতিদিন ডুবে যায়। আর ভাঙনে এসব ওয়ার্ডের ১৫০টি পরিবারের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ভেঙে গেছে।

সত্তরোর্ধ্ব রুহুল আমিন মিজি জানান, তাঁর পরিবারের ১০ একর জমি মেঘনা ও ইলিশা নদীতে বিলীন হয়েছে। কয়েকবার বাড়ি সরিয়ে উত্তর রামদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গড়েছেন। এখন সেটি ভাঙনের মুখে। গত আম্পানের পর থেকে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে জোয়ারে তাঁর ঘর প্লাবিত হচ্ছে। এ সময় রান্না করতে, উঠতে-বসতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

তাছনুর বেগম (৩৩) নামের এক নারী বলেন, ভাঙনে তাঁদের জমি বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে টিকে আছে শুধু ঘর। সে ঘরের ভিটা জোয়ারের তোড়ে ভেঙে যাচ্ছে। তাঁর স্বামী নদীতে মাছ ধরেন। বাচ্চাদের নিয়ে রাতবিরাতে ভাঙা ঘরে থাকতে ভয় করে।

স্থানীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমির হোসেন বলেন, ভাঙনের কারণে রাজাপুরের হাজার হাজার পরিবার নিঃস্ব, সহায়-সম্বলহীন বাস্তুহারা। এসব পরিবারের নারীরা ঢাকায় কাজের বুয়া, শ্রমিকে পরিণত হয়েছেন। রাজাপুরের দক্ষিণাংশে যেটুকু টিকে আছে, সেটি রক্ষা না পেলে রাজাপুরসহ ভোলার মানুষ ভাঙনের কবলে পড়বে।