আদালতের মধ্যস্থতায় টিকে গেল ১৭ বছরের সংসার, পড়ানো হলো বিয়ে

পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মতিউর রহমানের খাসকামরায় রোববার দুপুরে সন্তানদের সামনে শাহানুর–আকতারা দম্পতির আবারও বিয়ে পড়ানো হয়
ছবি: প্রথম আলো

শাহানুর ইসলাম ও আকতারা বানুর ১৭ বছরের সংসার। দুই মেয়ে ও এক ছেলে এ দম্পতির। পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রী বাবার বাড়িতে চলে যাওয়ায় রাগের মাথায় তালাক দিয়েছিলেন শাহানুর। এরপর স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা করেন স্ত্রী আকতারা। মামলার জামিন নিতে এসে বিচারকের মধ্যস্থতায় অবশেষে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে সন্তান ও স্বজনদের উপস্থিতিতে আবারও আকতারাকে বিয়ে করেন শাহানুর। আদালতের মধ্যস্থতায় টিকে গেল ১৭ বছরের সংসার।

আজ রোববার দুপুরে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মতিউর রহমানের খাসকামরায় এ বিরোধের মীমাংসা হয়। বিচারক, দুই পক্ষের আইনজীবী, ওই দম্পতির তিন সন্তান ও স্বজনদের উপস্থিতিতে আদালত মসজিদের ইমাম আবদুল খালেক তাঁদের বিয়ে পড়ান। বিয়েতে স্ত্রী আকতারার (৩৬) হাতে নগদ এক হাজার টাকা মোহরানা বুঝিয়ে দেন স্বামী শাহানুর (৪২)। এ সময় সেখানে আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালের ৫ জানুয়ারি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের মকছেদ আলীর ছেলে কৃষক শাহানুরের সঙ্গে একই ইউনিয়নের আরাজী-শিকারপুর এলাকার আশরাফ আলীর মেয়ে আকতারার বিয়ে হয়। তাঁদের সংসারে ১৫ ও ৪ বছর বয়সী ২টি মেয়ে এবং ৯ বছর বয়সী ১টি ছেলে আছে। ছয় মাস আগে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহের জেরে আকতারা বাবার বাড়িতে চলে যান। তাঁর সঙ্গে দুই মেয়ে গেলেও বাবার সঙ্গে ছিল ৯ বছর বয়সী ছেলে। রাগের মাথায় শাহানুর গত বছরের ১২ অক্টোবর আইনজীবীর মাধ্যমে স্ত্রী আকতারাকে তালাক দেন। পরে চলতি বছরের ৩০ মার্চ আকতারা তাঁর স্বামী ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে যৌতুক নিরোধ আইনে আদালতে একটি মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে সমন জারি করে আজ আদালতে হাজির হওয়ার আদেশ দেন।

আদালত সূত্রে আরও জানা যায়, আজ সকালে মামলার আসামি শাহানুর আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। তখন আদালত বাদী-বিবাদী ও তাঁদের সন্তানদের দেখে দুই পক্ষকে ডেকে মীমাংসার প্রস্তাব দিলে দুজনই রাজি হয়ে যান। সন্তান ও স্বজনদের উপস্থিতিতেই বিচারকের খাসকামরায় আবারও বিয়ের আয়োজন করা হয়। এ সময় আকতারার বাবা আশরাফ আলী নতুন করে মেয়েকে শাহানুরের হাতে তুলে দেন। এ সময় তাঁদের জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়।

আকতারা বানু প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বামীর তালাক দেওয়ার কথা শুনে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তার মধ্যে ছিলাম। আদালতে বিচারকের মাধ্যমে আবারও নতুন করে সংসার হলো। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’

পঞ্চগড়ে আদালতের মধ্যস্থতায় আকতারা বানুর বাবা আশরাফ আলী তাঁর মেয়েকে জামাই শাহানুরের হাতে তুলে দেন। এ সময় ওই দম্পতির সন্তানেরা ও আদালতের বিচারক উপস্থিত ছিলেন
ছবি: প্রথম আলো

শাহানুর ইসলাম বলেন, ‘স্ত্রী-সন্তান কাছে না থাকায় সত্যিই খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। রাগের মাথায় তালাক দিয়েছি। স্ত্রীও আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এ জন্য কখনো ভাবিনি যে আবার সংসার হবে। কিন্তু আদালতে এসে বিচারকের কথা শুনে আর ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে মনটা পাল্টে গেছে। আমরা নতুন করে সংসার করতে চাই। সন্তানদের মানুষ করতে চাই।’

মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী মকবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ওই দম্পতির বড় মেয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে। তিন সন্তানের কথা ভেবে ১৭ বছরের একটি সংসারকে টেকানোর জন্য বিচারক মতিউর রহমানের এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। তাঁরা দুজন আগে থেকেই স্বামী-স্ত্রী। যেহেতু স্বামী তালাক দিয়েছিলেন, এ জন্য সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের আবার বিয়ে পড়ানো হলো। তিনি পরিবারটির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করেন।

আসামিপক্ষের আইনজীবী হাজিজুর রহমান বলেন, ‘একজন বিচারকের মধ্যস্থতায় দীর্ঘদিনের একটি সংসার টিকে গেল। আদালতেই তাঁদের নতুন করে বিয়ে পড়ানো হয়েছে। সন্তানেরা তাদের বাবা–মায়ের পরিচয়ে বড় হতে পারবে, এটা ভেবে খুবই ভালো লাগছে। বিচারক মতিউর রহমানের মহৎ উদ্যোগের সাক্ষী হতে পেরে এবং এ কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পেরে গর্ববোধ করছি।’