‘আলো-বাতাস ঢোহে হেইরম একটা ঘরে থাইক্যা মরতে চাই’

২০ বছর ধরে অন্যের বাড়িতে খুপরিঘরে বসবাস করেন জহুরজান বিবি। বৃহস্পতিবার দুপুরে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার মদনপুরা ইউনিয়নের চন্দ্রপাড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

বয়সের ভারে ন্যুব্জ জহুরজান বিবি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তাঁর বয়স ৯৫ বছরের বেশি। দেখভাল করার মতো কেউ নেই। কোনো বেলা খেয়ে, কোনো বেলা না খেয়েই চলছে জহুরজান বিবির জীবন। এমনকি মাথা গোঁজার মতো নিজের কোনো বসতঘরও নেই। বাধ্য হয়ে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার মদনপুরা ইউনিয়নের চন্দ্রপাড়া গ্রামে অন্যের বাড়িতে একটি খুপরি ঘরে প্রায় ২০ বছর ধরে একা বসবাস করছেন তিনি।

জহুরজান বিবি বলেন, ‘অসুস্থ হইয়া গ্যালে আল্লারে ডাহোন (ডাকা) ছাড়া দেহার মতোন কেউ নাই। অনেক বয়স হইছে। এহন আর কামকাইজ (কাজকর্ম) করতে পারি না। মাঝেমইদ্যেই না খাইয়া থাকতে হয়।’

দরিদ্র এই বৃদ্ধা আরও বলেন, ‘হুনছি শেখের মাইয়ায় (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) জমি দেয়, ঘর দেয়। কিন্তু আমার মতো অসহায় গরিবরে কেউ ঘর দেয় না। কোমনে (কোথায়) গেলে ঘর পামু, তা–ও কেউ কয় না। তুমি (সাংবাদিক) বাবা আমারে একটা ঘর পাওনের ব্যবস্থা কইরা দাও। আলো-বাতাস ঢোহে, হেইরম একটা ঘরে থাইক্যা (থেকে) মরতে চাই।’

বৃহস্পতিবার দুপুরে চন্দ্রপাড়া গ্রামে জহুরজান বিবির খুপরিতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের মধ্যে লাঠি হাতে বসে আছেন জহুরজান বিবি। যে খুপরিতে থাকেন, এর পাশেই একটি গবাদিপশুর (গরু) ঘর। সেখান থেকে দুর্গন্ধ আসছিল। খুপরিটির মধ্যে সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না। ঘরে নেই দিন ও রাতের কোনো তফাত। আলো ঢুকতে না পারায় দিনের বেলায়ও ভেতরে থাকে অন্ধকার। শোয়ার চৌকিটি ভাঙা। ঘরে রয়েছে দুটি পাতিল, একটি থালা, একটি মগ ও একটি হাতুয়া (মাটির গামলা)। একটি মাটির হাঁড়িতে পানি রাখেন। বাড়ির অন্য সব ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বললেও সন্ধ্যা হলে কুপি (বাতি) জ্বালিয়েই ঘর আলোকিত করতে হয় জহুরজান বিবিকে।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও জহুরজান বিবি নামাজ–রোজা ছাড়েন না—এমনটাই জানিয়েছেন প্রতিবেশীরা। এ বছরও এখন পর্যন্ত সব কটি রোজা রেখেছেন। ওই বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জহুরজান বিবির বাড়ি ছিল ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার খাসেরহাট গ্রামে। স্বামীর নাম মো. আয়নাল হক। নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায় তাঁদের পরিবার। একপর্যায়ে স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দুই শিশুকন্যা রাহিমা ও নাসিমাকে নিয়ে ১৯৪৮ সালের বন্যার চার-পাঁচ বছর আগে ঘর থেকে বের হয়ে যান। এরপর তাঁর চাচাতো বোন আনোয়ারার স্বামীর বাড়ি বাউফল উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের ছোট ডালিমা গ্রামে চলে আসেন। ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চুন্নু মিয়ার বাড়ি থেকে কাজ করে দুই শিশুকন্যাকে বড় করেন। ওই ইউপি চেয়ারম্যান জহুরজান বিবির দুই মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করেন।

প্রায় ৪০ বছর ছিলেন ওই ঘরে। চুন্নু মিয়া মারা যাওয়ার পর চলে আসেন একই উপজেলার মদনপুরা ইউনিয়নের চন্দ্রপাড়া গ্রামে। এই গ্রামেও বিভিন্ন বাড়িতে থাকেন আরও কয়েক বছর। দুই মেয়ের সংসারেও অভাব। তাঁরা মায়ের খোঁজখবর নেন না। শেষ আশ্রয় হয় গ্রামের আবদুল মোতালেব মৃধার বাড়িতে। আবদুল মোতালেব মৃধা (৭০) তাঁর ঘরের পাশে খুপরি তুলে দিলে সেখানে বসবাস শুরু করেন জহুরজান বিবি। প্রায় ২০ বছর পর্যন্ত ওই খুপরিতেই থাকছেন এই বৃদ্ধা। ভোলা থেকে চলে আসার পর স্বামীর সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি তাঁর।

ওই বাড়ির গৃহবধূ নাজমা বেগম (৪০) বলেন, ‘হাঁটু সোজা করতে না পারলেও নামাজ ছাড়েন না জহুরজান বিবি। এ জন্যই হয়তো আল্লাহ তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আপনি (সাংবাদিক) তাঁকে একটা ঘর পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। বৃষ্টি হলে ওই ঘরে থাকতে তাঁর খুব কষ্ট হয়।’

জহুরজান বিবির জন্য একটি ঘর পাইয়ে দেওয়ার দাবি করেছেন আশ্রয়দাতা আবদুল মোতালেব মৃধাও। তিনি বলেন, ‘আগে অন্যের বাড়িতে কাজ করলেও এখন আর কাজ করতে পারেন না জহুরজান বিবি। বছর দুই আগে বয়স্ক ভাতার তালিকায় নাম পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। সেটা দিয়ে ওষুধপত্র কিনে দিই। আর যে যা দেন, তা দিয়েই জীবন চলে তাঁর।’

জানতে চাইলে বাউফলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল আমিন বলেন, ‘বিষয়টি খুবই দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখব—কী করা যায়।’