ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার আসামি আশরাফুল ইসলাম জিতু গ্রেপ্তার হলেও তাঁর সহযোগীদের এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা যায়নি।
এদিকে শিক্ষক হত্যার ঘটনার জের ধরে পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি গতকাল শনিবার আবার খুলেছে। ইতিমধ্যে হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ সাইফুল হাসান সড়কে দাঁড়িয়ে অপরিচিত যুবকদের সরিয়ে দিচ্ছেন। এ সময় প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা রয়েছে। জিতুকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করতে পারে। তাই আমিসহ শিক্ষকদের একটি অংশ চারটি দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন স্থানে টহল দিচ্ছি।’
‘রাস্তায় যানজট থাকার কারণে যথাসময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আমরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। ক্লাস চলাকালে আমাদের সার্বক্ষণিক টহল থাকবে।’আল মামুন কবির, আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই)
অধ্যক্ষ বলেন, শিক্ষককে হত্যার পর অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকই তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। গতকাল ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সামনে ঈদ। তাই আন্দোলনের সময় অনেক শিক্ষার্থী বাড়ি চলে যাওয়ায় ক্লাসে প্রভাতি শাখায় তাদের উপস্থিতি ৫৩ শতাংশ ও দিবা শাখায় ৬০ শতাংশ ছিল।’
উৎপল কুমারকে হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে জানিয়ে অধ্যক্ষ বলেন, পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত ও গ্রেপ্তার হওয়া আসামির জবানবন্দিতে ওই ঘটনায় এই ছাত্রীর সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে এসেছে। তাই পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, গতকাল প্রভাতি শাখায় (প্লে থেকে চতুর্থ) শিক্ষা কার্যক্রম চলে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। দিবা শাখার (পঞ্চম থেকে দ্বাদশ) শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয় সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে। এই সময়ে এ এলাকায় পুলিশের কোনো সদস্যকে দেখেননি তাঁরা। তবে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আশুলিয়া থানা-পুলিশের একটি দল আসে।
দশম শ্রেণির বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থী তামান্না আক্তার প্রথম আলোকে বলে, স্কুলে আসতে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। স্কুল শুরুর আগে যেসব কিশোর সড়কে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের আজ দেখা যায়নি। স্কুলের আশপাশে পুলিশ থাকলে ভালো হতো। সবাই স্কুলে আসতে ভয় পেত না।
‘প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরু হওয়ার সময়টি হয়তো পুলিশকে যথাযথভাবে জানানো হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবাইকে কোনো সমস্যা হলে প্রয়োজনে আমাকে সরাসরি জানাতে বলেছি। বিষয়টি আমাকে কেউ জানায়নি।’মো. মারুফ হোসেন সরদার, পুলিশ সুপার
বখাটেদের হামলার ব্যাপারে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। এ বিষয়ে গত শুক্রবার সকালেই প্রতিষ্ঠানটিতে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সরদারকে জোরালোভাবে জানান তাঁরা। পরে শিক্ষা কার্যক্রম চলাকালে ওই এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে বলে পুলিশ সুপার তাঁদের আশ্বাস দেন। ওই আশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গতকাল আবার ক্লাসে ফিরেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
বেলা ১১টার দিকে শিক্ষক মো. শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রেপ্তার আশরাফুলের সহযোগীদের তো এখনো চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে এখনো আমরা নিরাপদ বলতে পারি না। পুলিশের একটি টহল টিম সকাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির সামনে থাকার কথা থাকলেও তারা সকালে আসেনি।’
এ বিষয়ে আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আল মামুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাস্তায় যানজট থাকার কারণে যথাসময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আমরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। ক্লাস চলাকালে আমাদের সার্বক্ষণিক টহল থাকবে।’
জানতে চাইলে পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সরদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরু হওয়ার সময়টি হয়তো পুলিশকে যথাযথভাবে জানানো হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবাইকে কোনো সমস্যা হলে প্রয়োজনে আমাকে সরাসরি জানাতে বলেছি। বিষয়টি আমাকে কেউ জানায়নি।’
আশুলিয়া থানা–পুলিশকে ওই এলাকায় কেউ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘কিছু বিষয় আমি শুনলাম, এক্ষুনি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে থানাকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।’
শ্রেণিকক্ষ লক্ষ্য করে বাজে মন্তব্য বখাটের
বন্ধের পর ক্লাস শুরুর দিনই মোটরসাইকেল আরোহী এক বখাটের বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শ্রেণিকক্ষের দিকে তাকিয়ে বাজে মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, ওই মোটরসাইকেলে কিশোর চালক ছাড়াও ছিল আরও দুই কিশোর।
সকালে কলেজের পাশে আসতেই চলন্ত অবস্থায় মোটরসাইকেল থেকে সড়কঘেঁষা একটি শ্রেণিকক্ষের দিকে তাকিয়ে তাদের একজন মন্তব্য ছুড়ে দেয়, ‘ও সুন্দরী!’ কিছুটা এগোতেই এক ছাত্রীকে কলেজের সামনে সড়কে দেখে মোটরসাইকেলটি ব্রেক কষে দাঁড়ায়। ছাত্রীটি তাদের অতিক্রম করে কলেজের মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। তখন মোটরসাইকেলের আরোহীরা মূল ফটকের সামনে এসে পরিচিত এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কিছু বলে দ্রুত চলে যায়।
শিক্ষককে হত্যার ঘটনায় সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এরই মধ্যে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একাধিকবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শনে গেছেন। তবে এতসবের কোনো প্রভাব মোটরসাইকেল আরোহী তিন কিশোরের মধ্যে গতকাল দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
শিক্ষকের স্মরণে প্রতীকী মানববন্ধন
বেলা একটার দিকে কলেজের মূল ফটকের সামনের সড়কে শিক্ষক উৎপলের স্মরণে পাঁচ মিনিটের প্রতীকী মানববন্ধন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। পরে পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১৫ জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিতে ছুটি ঘোষণা করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এরপর ক্লাস ছুটি দেওয়া হয়।
গত শনিবার ওই কলেজের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলাকালে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আশরাফুল অতর্কিতে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের ওপর হামলা চালান। প্রথমে শিক্ষকের মাথায় আঘাত করেন তিনি। পরে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকেন। সোমবার ভোরে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এ ঘটনার মূল আসামি আশরাফুল ও তাঁর বাবা উজ্জ্বল মিয়াকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।