আশ্রয়কেন্দ্রে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন

আশ্রয়কেন্দ্রে অসুস্থ স্বামীর সেবা করছিলেন স্ত্রী খাদিজা বেগম। সোমবার নগরের মিরাবাজার এলাকার কিশোরী মোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে
ছবি: প্রথম আলো

গায়ে জ্বর, মাথাব্যথা। চার দিন ধরে মুখে রুচি নেই। ওষুধের দোকান থেকে কিনে এনেছেন মাথাব্যথা ও জ্বরের¦ওষুধ। সেগুলো খেয়ে কাপড় বিছিয়ে শুয়েছিলেন ইমান আলী (৬৫)। পাশেই বসে কথাগুলো বলছিলেন স্ত্রী খাদিজা বেগম (৬৫)।

সিলেট নগরের মিরাবাজার এলাকার কিশোরী মোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে আশ্রয় নিয়েছেন খাদিজা বেগম। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে এই আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। ওই কক্ষে তাঁদের সঙ্গে আরও নয়টি পরিবার থাকছে। ইমান আলীর মতো সেখানে আরও অনেকের অসুস্থ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন

খাদিজা বেগম বলেন, স্বামী দিনমজুরির কাজ করেন। বন্যার পানি ও বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে তাঁর। ওষুধ খেয়েছেন, তবে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে তাঁদের কোনো ওষুধ কিংবা খাওয়ার স্যালাইন সরবরাহ করা হয়নি। তিনি বলেন, স্বামী ও এক মেয়েকে নিয়ে থাকেন নগরের মিরাবাজার এলাকার ইউসুফ মিয়ার কলোনিতে। স্বামীর দিনমজুরি ও মেয়ের গৃহকর্মীর কাজ করে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চলে। তাঁদের ঘরে চাল-ডাল যা ছিল, সব বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এখন খাট-পালঙ্ক ছাড়া আর কিছুই নেই। সেগুলোও পানিতে তলিয়ে আছে। প্রথম দফা বন্যায় তাঁদের অনেক জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে। এক মাসের মাথায় ফের বন্যায় আরও ক্ষতির মুখে পড়লেন। দুই দফা বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে খাদিজার।

আশ্রয়কেন্দ্রের দ্বিতীয় তলায় আঙিনায় পাতা একটি বেঞ্চে শুয়েছিলেন হালিমা বেগম (৩৫)। বেঞ্চের নিচে মুরগির চিক চিক ডাক শোনা যাচ্ছিল। দেখা যায়, একটি প্লাস্টিকের খাঁচায় দুটি মুরগি। আশ্রয়কেন্দ্রের দ্বিতীয় তলার আঙিনাটি কাপড় দিয়ে ঢাকা। বৃষ্টি হলে যাতে গায়ে পানি না পড়ে, সে জন্য কাপড়গুলো টাঙানো হয়েছে। যতরপুর এলাকার হিরা মিয়ার কলোনিতে থাকেন হালিমা। সঙ্গে স্বামী, সন্তানসহ চারজন। ঘরে দুটি মুরগি ছিল আশ্রয়কেন্দ্রে আসার পথে সেগুলোও নিয়ে এসেছেন।

আরও পড়ুন

হালিমা বেগম বলেন, আশ্রয়কেন্দ্র থেকে তাঁদের কোনো ওষুধ সরবরাহ করা হয়নি। সরকারিভাবে কোনো খাবারও দেওয়া হয়নি। তবে ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে খাবার দিয়েছেন। এর মধ্যে সকালে একদল স্বেচ্ছাসেবক রান্না করা খিচুড়ি দিয়ে গেছেন। এ ছাড়া কিছু চিড়া–মুড়িও পেয়েছেন। এভাবে দিন পার করছেন তাঁরা।

তৃতীয় তলার একটি কক্ষে লাইলি বেগম (৩৫) বসে গল্প করছিলেন। তিনি থাকেন নগরের যতরপুরের জায়িদ মিয়ার কলোনিতে। ছেলেমেয়ে, স্বামীসহ চারজন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। ঘরে এখনো কোমরপানি। ওই দিন বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে ভিজে জ্বর উঠেছিল লাইলির। সঙ্গে গায়ে ব্যথা। ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খেয়েছেন। এখন সুস্থ। তবে শরীর কিছুটা দুর্বল। ভালো চিকিৎসক দেখাবেন, সেই উপায় নেই। অসুস্থ শরীর নিয়েই চলছেন তিনি।

লাইলি বলেন, বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে ভিজে অনেকে অসুস্থ। তবে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। সবাই নিজ উদ্যোগে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে খাওয়ার পানির সংকট আছে। শৌচাগারে পানি নেই। এ জন্য নিচ থেকে সিটি করপোরেশনের দেওয়া পানি বয়ে তুলতে হয়। এতে শরীরের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

আশ্রয়কেন্দ্রের বারান্দায় ব্রেঞ্চে বসেছিলেন মনু মিয়া (৩৮) ও স্ত্রী শামিরুন বেগম (২৮)। তাঁরা সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার আফনা গ্রামের বাসিন্দা। থাকেন মিরাবাজার এলাকার মাহমুদ মিয়ার বাসায়। এক মাস আগের বন্যায় ঘরে পানি না ঢুকলেও এবার ঘরে কোমরসমান পানি। ঘরে থাকতে না পেরে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। শামিরুন বেগম বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে শৌচাগারের অবস্থা খুবই খারাপ। বিদ্যালয়ের মোটর নষ্ট বলে শুনেছেন। আশ্রয়কেন্দ্রের খোঁজ কেউ নেন না। এ জন্য তাঁদের কষ্টও কেউ বোঝে না।

আরও পড়ুন

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বন্যার্তদের চিকিৎসায় তিনটি দল করা হয়েছে। প্রতিটি দলে একজন চিকিৎসকের নেতৃত্বে সাতজন সদস্য আছে। তাঁরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন। খাওয়ার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিচ্ছেন। বন্যার পানি বেশি থাকায় কয়েকটি ওয়ার্ডে প্রবেশ করতে পারেননি তাঁরা। আশা করা যাচ্ছে, কাল–পরশুর মধ্যে ওই ওয়ার্ডগুলোও পরিদর্শন করবেন। ওই আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যাপারে খোঁজ নেবেন বলে জানান তিনি।

সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, সিলেট সিটি করপোরেশনের ৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেগুলোতে চিড়া, মুড়ি ও বিস্কুট বিতরণ করা হচ্ছে। তবে রান্না করা খাবার বিতরণের সুবিধা না থাকায় সেটি করা হচ্ছে না। সেই সঙ্গে সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ পাওয়া ৩০ মেট্রিক টন চাল কয়েক দিনের মধ্যেই ওয়ার্ডগুলোতে বিতরণ করা হবে বলে তিনি জানান।

আরও পড়ুন